লতাজি এবং রাহুল দেববর্মন, শচীন কর্তার দুই দুঃখের কারণ

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 05:06:36

১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মারা যান কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মন (এস ডি বর্মন)। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার এক সঙ্গীতশিল্পী-পরিবারে তাঁর জন্ম। ছিলেন ত্রিপুরা রাজবংশের সন্তান। আগরতলার বাসিন্দা হলেও শচীন দেবের শৈশব কেটেছে কুমিল্লায় এবং শেষ জীবন মুম্বাইতে। তাঁর সহধর্মিণী মীরা দেবী এবং একমাত্র পুত্র রাহুল দেববর্মনও মুম্বাই চিত্রজগতের প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী।

রাগসঙ্গীতে তাঁর ভালো দখল ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে তিনি ত্রিপুরার রাজদরবারে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে ওস্তাদ বাদল খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ভীষ্মদেব, কানা কৃষ্ণ প্রমুখ সঙ্গীত বিশারদের নিকট রাগসঙ্গীতে আনুষ্ঠানিক তালিম নেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীন দেব প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। তিনি নজরুল সঙ্গীতও রেকর্ড করেন। এরপর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ডকৃত তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো: ‘যদি দখিনা পবন’ (রাগপ্রধান), ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (কাব্যগীতি), ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ (পল্লীগীতি), ‘বধুঁগো এই মধুমাস’ (পল্লীগীতি)।

◤ মা-বাবার সাথে ছোট্ট শচীন ◢


১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি এবং চলচ্চিত্রে হিন্দি গানের নেপথ্য গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এর আগে ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি। তিনি যখন খ্যাতির চূড়োয় তখন দুটো মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। প্রচল আছে একটি আঘাত পান লতা মঙ্গেশকরের কাছ থেকে অন্যটি তাঁর ছেলে গায়ক ও সুরকার রাহুল দেববর্মনের কাছ থেকে।

সেই দুটি আঘাত ও শেষ গানে মৃত্যু

অনেক দিন পরে ‘মিলি’ ছবির গানে নিজেকে যেন নতুন করে উজাড় করে দিচ্ছিলেন শচীন কর্তা। এমনিতেই শচীন দেববর্মনের গান মানেই মেঠো সুর। মিঠে সুর। বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র ছিলেন শচীন কর্তার গানের গুরু। ত্রিপুরা সম্বন্ধে এমনিতেই প্রবাদ আছে, সেখানকার রাজবাড়িতে রাজা-রানি, কুমার-কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত সবাই গান জানে। গান গায়। তো, শচীন কর্তা যে সুরের রসে মজে থাকবেন এবং মজাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।

তাহলে হঠাৎ এই বিশেষ ছবির গান নিয়ে আলোচনা কেন? আসলে তার বছর খানেক আগে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা ভীষণ আহত করেছিল শচীন দেববর্মনকে। তার পরেই এই ছবির গানে শচীন নিজেকে আবার নতুন করে প্রমাণ করতে বসেছিলেন নিজের কাছে। বরাবর দুজনকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল তাঁর। এক, ছেলে রাহুল দেববর্মন (আর ডি বর্মন)। দুই, লতা মঙ্গেশকর। ঘটনাচক্রে দুজনেই তাঁকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিলেন। সেই আঘাত এতটাই ছিল যে শচীন ঠিক করেছিলেন, গান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু ত্রিপুরার রাজকুমার ময়দান থেকে হেরে ফিরবেন, এটাও তো হওয়ার নয়। তাই ‘মিলি’ তাঁর হাতের শেষ অস্ত্র।

কিন্তু ময়দান ছাড়ার মতো কী এমন ঘটেছিল শচীন কর্তার সঙ্গে? মুম্বইয়ে শচীন কর্তার খুব প্রিয় নারী শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতার কথা উঠলেই তিনি বলতেন, “আমায় হারমোনিয়াম দে। লতাকে এনে দে। আর আধা ঘণ্টা সময় দে। আমি সুর করে দিচ্ছি।” লতাজির ওপর এতটাই ভরসা করতেন যে গীতা দত্ত প্রথম পছন্দ হলেও যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন লাতাজির ওপর। তাঁর মতে, “ওই মাইয়া আমায় জাদু করসে। ওরে ছাড়া আঁধার দেহি আমি।” পরে এই লাতাজিই প্রচণ্ড অপমান করেছেন শচীন কর্তাকে। কোনো সুরকার কখনো নিজের তৈরি স্বরলিপি কাছ ছাড়া করেন না। শচীনও এটাই করতেন। কিন্তু লাতাজি যখন সুরের দুনিয়ার মধ্যগগনে তখন বেয়াড়া আবদার করেছিলেন। তাঁর দাবি, গানের নোটেশন তাঁর হাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে তিনি সুর এদিক-ওদিক করে নেবেন। এই দাবি মানা কোনো সুরকারের পক্ষে সম্ভব? বিশেষ করে শচীন কর্তার মতো রাজবংশীয় ঘরানার মানুষ। যিনি বরাবরের স্বাধীনচেতা!

◤ লতা মঙ্গেশকরকে সুর বুঝিয়ে দিচ্ছেন শচীন কর্তা ◢


সুরের স্বরলিপির দখলদারি নিয়ে প্রথম দ্বন্দ্বের শুরু। কর্তা লতাজিকে ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, এই আবদার মানা সম্ভব না। জিদ্দি লতাজিও অনড় তাঁর চাহিদা থেকে। নিরুপায় কর্তা বাধ্য হয়ে লতাজির বদলে নিলেন তাঁর বোন আশা ভোঁসলেকে। সেই থেকে লতাজির সাথে শচীনের দূরত্ব বেড়ে গেল। এরপর একজন আরেকজনকে দেখলে এড়িয়ে যেতেন। শচীন লতার এই আবদারে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন বলে পরে জানান আরেক বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী। সেই সময় শচীন দেবের মতো অনেকেই লতাজিকে তাদের গান থেকে বাদ দিয়েছিলেন। এই ধাক্কায় মন ভেঙে গিয়েছিল শচীনের।

এর কয়েক মাস পরেই ঘটল দ্বিতীয় ঘটনা। দেব আনন্দ আর শচীনের জুটি প্রথম থেকেই সুপারহিট। দেব আনন্দ পরিচালনায় আসার পর ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ বানাবেন বলে ঠিক করলেন। সুর দেবার জন্য ডাক পড়ল শচীনের আর পঞ্চমের (তার ছেলে রাহুল দেববর্মন)। চিত্রনাট্য শোনার পর দুজনে দুজনের মতো করে সুর শোনালেন। পঞ্চমের গান বেশি পছন্দ হলো দেবের। তিনি শচীন কর্তাকে খুব নরম গলায় জানালেন, “এই ছবিতে পঞ্চমের সুর বেশি ভালো মানাবে। তাহলে পঞ্চম সুর দিক।” হাসিমুখে সম্মতি দিলেন শচীন। ছেলের উন্নতি দেখলে কোন বাবা না খুশি হয়? কিন্তু তার মনে এ কষ্ট ছিল নিজের ছেলে পঞ্চম (রাহুল) তাকে অনুসরণ করল না সুরে। সস্তা বাজিমাত কুড়ানোর জন্য পপ সুরের দিকে এগুলো। এটিও তিনি তার স্ত্রীকে মারা যাওয়ার আগের দিন বলেছিলেন।

◤ অপর দিকে আশা ভোঁসলেকে জনপ্রিয় ঘরানার সুর বুঝিয়ে দিচ্ছেন শচীনপুত্র রাহুল দেববর্মন ◢


আগ্রহ নিয়ে একদিন রেকর্ডিং রুমে ছেলের সুরও শুনতে এলেন। পঞ্চম (রাহুল) সেদিন ‘দম মারো দম’ গান তোলাচ্ছিলেন আশাজিকে। দু লাইন শোনার পরেই রাগে মুখ লাল এস ডি বর্মনের। চেঁচিয়ে উঠে পঞ্চমকে বললেন, “আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে।” রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কর্তা যখন মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন, সবার দেখে মনে হলো, রাজা যুদ্ধে হেরে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

◤ স্ত্রী মীরা দেবীসহ শচীন দেববর্মন ◢


রেকর্ডিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে কদিন গুম হয়ে বাড়ি বসে রইলেন। তারপর শুরু করলেন ‘মিলি’ ছবির গান। সুর দিতে দিতেই paralytic attak হলো কর্তার। কোমায় আচ্ছন্ন বাবার মাথার কাছে বসে ‘মিলি’র গানে সুর দিচ্ছেন পঞ্চম (রাহুল)। কিন্তু রাহুলের কণ্ঠে সেই পপুলার ধারার সুর। ছটফট করছিলেন। মীরা এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন, শচীন মীরাকে ফুটফুটিয়ে বললেন, “আমার সেই গানটা ধরো, ‘যদি দখিনা পবন’। মীরা সেই গান ধরলেন। একি রহস্য, দখিনা জানালা দিয়ে তখন অঝরে হাওয়া এসে ঢুকতে শুরু করল ঘরে। যেন ঝড়ো বাতাস। এরপর, মীরা ডাকলেন শচীনকে, কিন্তু শচীন সেই যে চোখ বন্ধ করলেন, আর খোলেননি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর