রডোডেনড্রনের পাশে আরেক ডারউইন

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 04:11:18

ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ডালটন হুকার-এর জীবনটা বড় অদ্ভুত, সংগ্রামশীল ও বৈচিত্রময়। তার বন্ধু বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন যখন জাহাজে চেপে দক্ষিণ আমেরিকার পথে চলেছেন, হুকার তখন চলে আসেন উল্টো দিকের ভারতে।

দুই আলাদা ও পৃথক ভূগোলে পাড়ি জমালেও দু’জনের মাঝে ভীষণ মিল। উভয়েই উদ্ভিদ ও জীব-জন্তু নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। জোসেফ ডালটন হুকার’কে নিঃসন্দেহে বলা যায় ‘ভারতের ডারউইন’।

ইংল্যান্ডে ডারউইন ও হুকারের শৈশব-কৈশোরটাও ছিল প্রচণ্ড রোমাঞ্চকর আর উত্তেজনায় ঠাঁসা। ইউরোপের দেশে দেশে তখন তৈরি হচ্ছে অভিযাত্রীর দল। আধুনিক জাহাজ আর উন্নত বৈজ্ঞানিক যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালের মধ্যে। সবাই ক্যাপ্টেন কুক এবং স্কটের মতো অভিযাত্রীর অনুপ্রেরণায় মাতোয়ারা। ঘরে থাকার লোকের চেয়ে বাইরের জগৎ দেখতে বেরিয়ে পড়ার মানুষের সংখ্যাই তখন বেশি।

ডারউইন ও হুকার প্রভাবিত হলেন তাদের সমকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা। ঘরে মন টিকলো না এই দুই বন্ধুর। প্রথমে বের হলেন তাঁর বন্ধু চার্লস ডারউইন। তিনি হলেন ‘বিবর্তনবাদ’-এর স্রষ্টা সেই ডারউইন, যিনি ‘এইচএমএস বিগল’ জাহাজে চেপে পৌঁছে গিয়েছিলেন গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে, এমন সব অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যা পরে রূপ পেয়েছিল জগৎ-কাঁপানো ‘থিয়োরি অব ইভোলিউশন’-এ।

হুকারেরও মন পড়ে ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, কিন্তু সে কালে পড়াশোনা, বিশেষত গবেষণার সুযোগ সুবিধা এতো প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। ফলে তাকে সুযোগের সন্ধান করতে হয়।

কারণ, পরিস্থিতি ছিল বাণিজ্যমুখী। টাকা কামানোর চেষ্টাই ছিল সকলের মধ্যে প্রধান। বিজ্ঞান বা গবেষণা চর্চার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার ফুসরত সাধারণ মানুষ বা নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে তখনো বৃদ্ধি পায় নি। এমন কি, ‘সায়েন্টিস্ট’ নামে যে একটি শব্দ আছে, সেটাই মানুষ জানত না। অভিধানেও ছিল না শব্দটি।

ফলে ডারউইনের মতো হুকারকেও সুযোগের সন্ধানে অপেক্ষা করতে হয়। এবং তার অপেক্ষা ছিল কিছুটা বেশি। অবশেষে এক সময় সুযোগ ধরা দিল। হুকার জুটে যেতে পারলেন ব্রিটিশ-বাংলামুখী বণিক-অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। অন্য ধরনের একদল মানুষের সঙ্গে তিনি নিজের মনের ইচ্ছা মনে পুষে বেরিয়ে পড়লেন সমুদ্রের অনিশ্চিত সফরে। ব্রিটিশ-ভারত অভিমুখী বণিকদের সঙ্গে এভাবেই হুকারের মতো এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী চলে এলেন উপমহাদেশের তৎকালীন কেন্দ্রস্থল অবিভক্ত বাংলায়।

বিরূপ পরিবেশ, বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রা ইত্যাদির পরেও লক্ষ্যে-অবিচল-প্রাণোচ্ছল ব্রিটিশ তরুণ মোটেও দমে যাননি। বরং সারা জীবন তিনি যে ভালোবেসেছেন গাছপালা, উদ্ভিদজগৎ, তার সন্ধানে পথ চলতে গিয়ে সব কষ্ট তিনি ভুলে গেলেন। হুকারের মনে একটাই ইচ্ছা, অজানা দূর দেশে বেরিয়ে পড়তে হবে, সেখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র, সব তথ্য লিখে রাখতে হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ-পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় পৌঁছে হুকার কাল-বিলম্ব করেন নি। নগর ও বাণিজ্যের টান তাকে আটকাতে পারল না। প্রকৃতির হাতছানিতে তিনি বেরিয়ে পড়লেন উত্তরের হিমালয়ান অঞ্চলের পথে। পথে নামলেন তিনি তার প্রথম গন্তব্যস্থল হিমালয়ের প্রবেশমুখ দার্জিলিঙের উদ্দেশে।

ঔপনিবেশিক আমলের কঠিন ও কষ্টকর যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়া ছিল এক রকম ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার। হুকার সেই রোমাঞ্চকর পথই বেছে নিলেন। পথের বিঘ্নের জন্য তিনি তার কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনা বাদ দিলেন না। বরং নানা ধরনের বাহনের সাহায্যে এগিয়ে যেতে লাগলেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।

হুকারের প্রথম বাহন ছিল হাতি। তিনি কলকাতা থেকে চুনারের কাছে মির্জাপুর অবধি গেলেন হাতির পিঠে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে সেখান থেকে জলপথে পৌঁছালেন শিলিগুড়ি। তারপর বাকিটুকু পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিলেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে। অবশেষে তিনি হিলটাউন দার্জিলিঙ এসে উপস্থিত হলেন। দিনটি ছিল ১৮৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল।

দার্জিলিঙ-এ অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি আর নয়ন জুড়ানো রডোডেনড্রনের আলোকিত উদ্ভাস দেখে বিদেশি উদ্ভিদবিজ্ঞানী বিমুগ্ধ। ভুলে গেলেন কষ্টকর পথের ক্লান্তি। মেতে উঠলেন পুষ্প, পত্রালী ও উদ্ভিদে। ডারউইনের সঙ্গে অনেকগুলো মিল থাকলেও হুকারের একটি বড় পার্থক্য আছে। ডারউইন গিয়েছিলেন মহাসমুদ্রের দ্বীপে। হুকার এসেছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে, পাহাড়ে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর