পৃথিবীর যমজ বোন শুক্র গ্রহের গল্প

, ফিচার

সাইফুল মিল্টন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 19:45:50

সৌর জগৎকে যদি একটি পরিবার ধরা হয় তবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’ পৃথিবীর কিন্তু একটি যমজ বোন আছে; সেটি হলো শুক্র গ্রহ। আকার-আকৃতি ও গাঠনিক উপাদানের সাদৃশ্যের জন্যই এরকমটি বলা হয়ে থাকে। সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে এটি দ্বিতীয় ও পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশি গ্রহ। সাধারণভাবে পৃথিবীর আকাশে ভোরবেলায় একে ‘সুক তারা’ ও সন্ধায় ‘সন্ধ্যা তারা’ নামে ডাকা হয়।

শুক্র গ্রহের অনেক বৈশিষ্ট্য একে সৌর জগতের ব্যতিক্রমধর্মী গ্রহ হিসাবে পরিচিত করেছে। সেসব বলার আগে ছোট্ট করে এ গ্রহের নামকরণ নিয়ে একটু বলে আসি। গ্রহটির ইংরেজি নামটি এসেছে রোমান মিথলজির এক প্রেমের দেবী ভেনাসের নামানুসারে। গ্রিক পুরাণে আবার এই দেবীকেই বলা হয় ‘আফ্রোদিতি’। বাংলায় শুক্র গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে বৈদিক পুরাণের দেবতা শুক্রাচার্যের নাম থেকে। ভারতীয় মিথলজিতে শুক্রাচার্য একজন প্রাচীন দেবতা যিনি অসুর বা দৈত্যদের গুরু। মধ্যযুগীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রে শুক্রকে ‘শত্রু গ্রহ’ হিসাবেও অবিহিত করা হয়েছে। যুগে যুগে প্রকৃতি পূজারি প্যাগানরা শয়তান বা লুসিফারের পূজা হিসাবেও এ গ্রহটিকে উপাসনা করে এসেছে।

মিথলজির জগৎ থেকে এবার বাস্তবে ফিরে আসি। বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে উদঘাটন করার চেষ্টা করি গ্রহটির স্বরূপ। আরো আলোচনা করতে চাই গ্রহটির অতীত নিয়ে যা থেকে মহাকালের পরিক্রমায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ রূপান্তর নিয়েও হয়তোবা কোনো অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে।

২৪ ঘণ্টায় দিন আর ১২ মাসে বছর দেখে অভ্যস্ত আমরা পৃথিবীর মানুষেরা কি ভাবতে পারি সৌর জগতে এমন গ্রহও আছে যেখানে এক বছরের চেয়ে এক দিন বড়! এজন্যই শুক্রকে বাতিক্রমধর্মী বলেছিলাম। ভেনাস বা শুক্র নিজ অক্ষের মধ্যে এতটা ধীর গতিতে ঘোরে যে এটির ‘এক দিন’ পৃথিবীর প্রায় ২৪৩ দিনের সমান। অথচ আপন কক্ষপথে ‘পৃথিবীর ২২৫ দিনে’ গ্রহটি সূর্যের চারিদিকে একবার পরিক্রম করে। অর্থাৎ, ‘পৃথিবীর ২২৫ দিনে’ শুক্র গ্রহের এক বছর। শুধু কি তাই? পৃথিবীসহ সৌর জগতের সব গ্রহ নিজ অক্ষের ওপর ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করে। কিন্তু ভেনাস ও ইউরেনাস এ দুটি গ্রহ ঘড়ির কাঁটার দিকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আবর্তিত হয়। যে কারণে শুক্র গ্রহে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয় ও পূর্ব দিকে অস্ত যায়। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আদিতে শুক্র গ্রহ অন্যান্য গ্রহের মতোই আবর্তিত হতো, কিন্তু বৃহদাকার কোনো গ্রহ/উপগ্রহের সাথে মহাসংঘর্ষের (ম্যাসিভ কলুশন) ফলে এটির ঘূর্ণন গতি স্থিমিত হতে হতে প্রায় স্থিরাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে উল্টো দিকে ধীর গতিতে ঘূর্ণন শুরু করেছে। গ্রহটির আরেকটি অবাক করা বিষয় হচ্ছে এটির কোনো উপগ্রহ বা চাঁদ নেই।

তবে শুক্রের এই চমকপ্রদ গল্প শুনতে শুনতে গ্রহটিতে ভ্রমণের ইচ্ছাপ্রকাশ ভুলেও করবেন না। কারণ বর্তমানে এটি একটি মৃত গ্রহ। সৌরজগতের উষ্ণতম গ্রহ। এটি কার্বনডাই অক্সাইডের তৈরি একটি মৃত্যুফাঁদ! শুক্রর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৯৬ শতাংই কার্বনডাই অক্সাইড, ৩.৫% নাইট্রোজেন ও সামান্য পরিমাণে অন্যান্য গ্যাস আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সালফারডাই অক্সাইড। গ্রহটির পুরু মেঘের স্তর ভেদ করে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না। এই গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ফলেই সময়ের পরিক্রমায় গ্রহটিতে এই ভূতুড়ে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অচিন্তনীয় বায়ুচাপ শুক্রের ভুপৃষ্ঠে আপনাকে দাঁড়াতেই দেবে না। নাসার বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ৭৫-১০০ গুণ বেশি বায়ুচাপ শুক্রপৃষ্ঠে।

নাসা সূত্রে প্রাপ্ত ভেনাসপৃষ্ঠের ছবি


 

অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মৃত্যুপুরী নাকি আনুমানিক ৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর মতোই বাসযোগ্য ছিল। নদী ছিল, সাগর ছিল, প্রাণের স্পন্দনও হয়তো ছিল। কিন্তু প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছরের পরিক্রমায় আমাদের সূর্য তার পূর্বাবস্থার চেয়ে ২৫% বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এরই সাথে সাথে শুক্র গ্রহের তাপমাত্রাও বহুগুণে বেড়েছে; ক্রমে ক্রমে বাষ্প হয়ে উধাও হয়ে গেছে এর নদী, সমুদ্রসহ সকল জলাধার। এই সময়েই পৃথিবীতে প্রাণসহনীয় তাপমাত্রার উন্মেষ ঘটেছে। শুক্র গ্রহের এই সুদূর অতীত আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বলে দেয়। আমরা ধারণা করতে পারি সৌর জগতের সূর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের বসুন্ধরা এক সময়ে শুক্রের মতো নরকগ্রহে পরিণত হবে। তবে বিজ্ঞানীদের আশা, মহাকালের স্রোতে সেসময় আমাদের সৌর জগতের ভিতরে বা বাইরে নিশ্চয়ই প্রাণের বসবাসযোগ্য অন্য কোনো গ্রহ দাঁড়িয়ে যাবে। সে গ্রহে বসেও কি কেউ সেদিন আমাদের পৃথিবীর অতীত নিয়ে লিখতে বসবে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর