শিল্পায়ন ও আবাসনের জন্য দিন দিন উজাড় হচ্ছে বন। ভরাট হচ্ছে জলাশয়, হাওর, বাওর ও নিম্নাঞ্চল। আশঙ্কাজনক হারে উজাড় হয়ে যাচ্ছে জীবনধারণের জন্য অক্সিজেনের যোগানদাতা উদ্ভিদ। উদ্ভিদ রক্ষায় সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ এক সময় তথা প্রায় ৮৫ বছর আগে একটি উদ্ভিদের বিস্তার রোধে তৈরি করা হয়েছিল আইন। বাড়ির আশেপাশে কিংবা ব্যক্তি মালিকানাভুক্ত জমিতে উদ্ভিদটি পাওয়া গেলে করা হয়েছিল জেল-জরিমানার বিধান। উদ্ভিদটির নাম ‘কচুরিপানা’। বাংলার অবহেলিত সৌন্দর্য।
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত ভাসমান জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা। বিশ্বের সব মহাদেশেই কচুরিপানা দেখতে পাওয়া যায়। তাই একে ‘কসমোপলিটন প্ল্যান্ট’ বা বিশ্বজনীন উদ্ভিদ বলা হয়। বাংলাদেশের নদ-নদী, পুকুর, জলাশয়, হাওর, বাওর ও নিম্ন জলাভূমিতে দেখা যায়। উপমহাদেশে এটি ‘বিদেশী আগাছা’ হিসাবে চিহ্নিত।
কচুরিপানা বহুবর্ষজীবী ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes. এটি Pontederiaceae গোত্রের একটি উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। আমাদের দেশে এটি আগাছা হলেও পাকিস্তানের ‘সিন্ধ’ প্রদেশের এটি ‘প্রাদেশিক ফুল’।
ধারণা করা হয় ১৮শ’ শতকের শেষের দিকে অর্কিডসদৃশ কচুরিপানা ফুলে মুগ্ধ হয়ে জনৈক ব্রাজিলীয় পর্যটক কচুরিপানা ফুলটি বাংলায় নিয়ে আসেন। এটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বাংলার প্রতিটি খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয় ভরে যায়। পাট ও আমন চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নৌ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
উইকিপিডিয়া অনুসারে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বঙ্গীয় জলাভূমি আইন, মিউনিসিপ্যালিটি আইন, স্থানীয় সরকার আইন ও স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন সংশোধন করে কচুরিপানার ধারা যুক্ত করেন। কিন্তু তা তেমন কার্যকর না হওয়ায় কচুরিপানা নিরোধে আলাদা আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৩৬ সালে 'The Bengal Water Hyacinth Act, 1936' বা বঙ্গীয় কচুরিপানা আইন নামে সরকার একটি আইন জারি করে। এ আইনে বাড়ির আশেপাশে ও নিজ দখলীকৃত জমিতে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেয়াকে উৎসাহিত করা হয়। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটগণ এলাকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সাথে নিয়ে কচুরিপানা দমনে আদিষ্ট হন।
১৯৩৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে কচুরিপানা দমনের অঙ্গীকার করা হয়। নির্বাচনে বিজয় লাভ করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে কচুরিপানা দমনে অভিযানে নেমেছিলেন।
ঢাকা মহানগরের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর, সিনিয়র আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞ এহসানুল হক সমাজী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ১৯৩৬ সালের `The Bengal Water Hyacinth Act, 1936 ‘ আইনটি সে সময় সমগ্র পশ্চিম বাংলায় কার্যকর ছিল। বাংলাদেশে এ আইনটি প্রযোজ্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, কচুরিপানায় প্রচুর পরিমাণে ফুল ফুটলেও ফল হতে তেমন একটা দেখা যায় না। এটি অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে দ্রুত বংশবিস্তার করে। এর অভিযোজন ক্ষমতা খুব বেশী। প্রতিকূল পরিবেশেও এটি বহু বছর টিকে থাকতে পারে।
তিনি বলেন, কচুরিপানার পাতা ডিম্বাকৃতির, চকচকে ও চর্মবৎ। এর বোঁটা স্ফীত ও স্পঞ্জি। ১৫-২০ সে.মি. লম্বা মঞ্জরিতে ৮-১৫টি দৃষ্টিনন্দন ফুল থাকে। প্রতিটি ফুল ৬টি পাপড়ি বিশিষ্ট। সাদা পাপড়িগুলো বেগুনী-নীল ছোপযুক্ত ও মাঝখানে হলুদ রঙের ফোটা থাকে।
ড. জসীম বলেন, ১৮শ’ শতকে এটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে জাপান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে। দেশে দেশে কচুরিপানা একটি জঞ্জাল হিসাবে পরিচিত। এটি দমনে বিভিন্ন দেশে আলাদা সরকারি ডিপার্টমেন্ট আছে মর্মে শোনা যায়।
তিনি আরও বলেন, এটি জঞ্জাল হলেও এর কিছু ভাল দিকও আছে। কচুরিপানা একটি ভাল জৈব সার। বন্যায় স্থলভাগ ডুবে গেলে কচুরিপানা গো-খাদ্যের জোগান দেয়। এছাড়া এটি থেকে দেশের ফরিদপুরে এক ধরনের কাগজ তৈরি করা হয়, যা জাপানে রপ্তানি করা হয়। হাওয়াই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এঞ্জেলা হোয়াইট তার গবেষণায় কচুরিপানার ডগাকে পুষ্টিকর সবজি উপাদান হিসাবে উল্লেখ করেন।
সাংবাদিক জাহিদুর রহমান ওরফে রহমান জাহিদ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন. শুকনা কচুরিপানা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি ক্ষারধর্মী হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে কচুরিপানার ছাই সোডার পরিবর্তে কাপড় কাচায় ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া কচুরিপানার ফুল বড়া বানিয়ে খাওয়া যায়।