বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে স্বপ্ন

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-24 14:42:52

আমাদের স্বপ্নের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কখনো আনন্দের স্বপ্ন দেখে মুখে হাসি ফোটে। আবার কখনো শরীর ঘেমে যাওয়া দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা। মাঝেমাঝে এমনও বহু স্বপ্ন দেখা যায় যার কোনো মানে নেই, নেই কোনো যোগসূত্র নিজের সাথে। কেমন হবে যদি স্বপ্নদেখার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়?

ব্যাপারটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন যাবত নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশার কথা হলো ইতোমধ্যেই তারা পেয়েছেন কল্পনাতীত সফলতা। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণা আমাদেরকে এই স্বপ্নদেখা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রেখেছে। যা আমাদের লুসিড ড্রিমিংয়ের ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে সক্ষম।

লুসিড ড্রিম মূলত স্বপ্নের এমন একটা অবস্থা যেখানে ঘুমন্ত ব্যক্তি বুঝতে পারেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন এবং এই স্বপ্নের ওপর তার হালকা নিয়ন্ত্রণও থাকে। স্বপ্নের চরিত্র, ভাষা এবং ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন৷ এমন স্বপ্নকেই লুসিড ড্রিমিং বলা হয় আর এই লুসিড ড্রিমিংকে নিয়েই বিস্তর গবেষণা হচ্ছে৷ আমরা যেন আমাদের এই ফ্যাসিনেশন থেকে সর্বোচ্চ এডভান্টেজ নিতে পারি, সে ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে গবেষকদের একটি দল।

২০১৬ সালের মেটা-বিশ্লেষণ অনুসারে, সারা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোক জীবনকালে কমপক্ষে একবার হলেও একটি চমকপ্রদ স্বপ্ন দেখে থাকেন। আবার অনেকেই প্রতিমাসেই এসব দেখেন। কেউ কেউ আবার মাসেই একাধিকবার এমন স্বপ্ন দেখে থাকেন৷ ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞানীগণ যখন প্রথম লুসিড ড্রিমিং সম্পর্কে একটি ল্যাবে পরিক্ষা নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হয়েছিলেন, তখন গবেষকরা সেগুলো কিভাবে ঘটতে পারে এবং কিভাবে তারা স্বপ্নদ্রষ্টাকে সাহায্য করতে পারেন সে সম্পর্কে আরো বেশি করে শিখতে পেরেছেন।

লুসিড ড্রিমিং নিয়ে গবেষণার ফলে স্বপ্নপরবর্তী বিভিন্ন প্রভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। যেমন দুঃস্বপ্ন দেখে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা কমানো। এছাড়াও শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন চেতনা সম্পর্কে রহস্য উদঘাটনে সহায়তা করছে এই গবেষণা।

মোট ১৬৯ জনের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদল ফলাফল প্রকাশ করেছে। যেখানে তাদের অবচেতন মনে দেখা স্বপ্নগুলোর বাস্তবিক রূপ দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে।

গবেষণায় যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের বলা হয়েছিল, তারা যেন প্রতিদিন অন্তত দশবার নিজেকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?” একটা চমৎকার তথ্য হলো আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন আমাদের মুখ হা করা থাকে৷ এবং এটাই অধিকাংশের ক্ষেত্রে ঘটে৷ যাই হোক, অংশগ্রহণকারীদের যখনই পরীক্ষার মুখোমুখী হতে হতো, তাদেরকে প্রকৃত স্বপ্নের মতোই একটি পরিবেশ দেওয়া হতো৷ উদ্দেশ্য ছিল যেন প্রকৃত ফলাফল বের হয়ে আসে।

একটি কক্ষে প্রায় পাঁচ-সাত ঘণ্টা ঘুমানোর পর তাদের ডেকে তোলা হতো। ঘুম ভাঙার পরে তাদেরকে প্রায় ৭০০ শব্দের একটি ডকুমেন্ট পড়তে দেওয়া হতো৷ যেই ডকুমেন্টের মূল বিষয় লুসিড ড্রিমিং। সেখানে লুসিড ড্রিমিংয়ের সময় কী করতে হবে, কিভাবে স্বপ্নকে চালিত করতে হবে এসব বিস্তারিত লেখা থাকত। যেহেতু এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল স্বপ্নের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, তাই এখানে এভাবেই লোকদের তৈরি করা হতো যেন স্বপ্ন তার আপন গতিতে প্রবাহিত হতে না পারে৷ স্বপ্নদর্শক যেন নিজ স্বপ্নকে ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে পারে৷ সে যেন তাই দেখতে পায়, যা সে আসলেই দেখতে চায়৷ ৫-৭ ঘণ্টা ঘুমানোর পর ঘুম থেকে উঠিয়ে ডকুমেন্ট পড়িয়ে আবার ঘুমাতে দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে—একবার ঘুম ভাঙার পরে যখন আবার ঘুম আসে, স্বপ্ন মূলত তখনই দেখা হয়। এজন্যেই আমরা অনেকেই স্বপ্ন দেখি ভোরবেলা৷ এর একটু আগে যখন আমাদের একটু ঘুম ভাঙে এবং আড়মোড়া দিয়ে যখন আমরা আবার ঘুমাই, ঠিক তখনই স্বপ্ন এসে উঁকি দিয়ে যায়৷

আমরা জানি আমরা যা স্বপ্ন দেখি তা আমাদের জীবনেরই প্রতিবিম্ব। আমাদের জীবনে যা ঘটে, অধিকাংশ সময় আমাদের অবচেতন মনে তা-ই দেখে থাকি। আর এই গবেষণাতেও এই টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ঘুমানোর আগে একটা বাক্য বারবার পড়তে বলা হতো। আর সেটা হলো, “এরপর আমি যা স্বপ্ন দেখব, তা আমি মনে রাখব”। এটাই হতো তাদের শেষ শব্দ। এই শব্দ বলেই তারা ঘুমাতে যেত। আর তাই এই শব্দগুলোই গেঁথে থাকত তাদের মাথায়। এবং এখানে প্রতিটা ব্যক্তিকে তাদের স্বপ্নগুলো লিখে রাখতে বলা হতো। দেখা হতো গত সপ্তায় দেখা তাদের স্বপ্নের সাথে এই সপ্তায় দেখা স্বপ্নের পার্থক্য কী। কোনো বিশেষ পার্থক্য পেলে তাও রেকর্ড করা হতো।

এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহে তাদের সাথে লুসিড ড্রিমিংয়ের টেকনিক ব্যবহার করা হতো না। তাই তাদের সবার স্বপ্ন আলাদা আলাদা রকমের হতো। একেকজন একেক বিষয়ের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যখন লুসিড ড্রিমিংয়ের ট্যাকনিক তাদের ওপর প্রয়োগ করা হলো, তখন দেখা গেল কেউ কেউ তাদের দেখা মোট স্বপ্নের ৪৬ শতাংশই লুসিড ড্রিমিং টেকনিক ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। অনেকে ১৭ শতাংশ, অনেকে ১১ শতাংশ করে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন সকলেই।

প্রসপেক্টিভ মেমোরি হলো এমন একটা বিষয় যেটা আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ধারণা প্রদান করে। ভবিষ্যতে আমরা কী করতে চাই তা আমাদের মনে রাখতে সাহায্য করে এই মেমোরি৷ এই গবেষণার একজন সহযোগী গবেষক ডেনহাম জে আস্পি বলেন, “আমি স্বপ্ন দেখব, এই কথাটা যখন বারবার উচ্চারণ করেন তখন সেটা প্রসপেক্টিভ মেমরিতে সেট হয়ে যায়। আর এই প্রসপেক্টিভ মেমোরিই লোকেদের একটি চমৎকার স্বপ্নের দিকে নিয়ে যায়৷”

যদিও প্রত্যেকের অবচেতন মনের স্বপ্নকে লুসিড ড্রিমে পরিবর্তন করতে হলে যেই প্রযুক্তির দরকার পড়বে এবং যেই দক্ষতা ও অনুশীলনের প্রয়োজন হবে, আমরা তার চেয়ে এখনো যোজন দূরত্বে আছি। কিন্তু আশার কথা হলো, সেই দূরত্বকে বাগে আনার জন্য কাজ শুরু হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর