‘মধু বৃক্ষ’ খেজুর গাছ

, ফিচার

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-12-22 21:11:21

রাজশাহী থেকে ফিরে: সরল গোলাকার কাণ্ডবিশিষ্ট, শাখা প্রশাখাবিহীন, একবীজপত্রী উদ্ভিদ খেজুর গাছ। গাছের মাথা একগুচ্ছ বড় লম্বাটে পাতা দ্বারা সজ্জিত। প্রতিটি পাতার বোঁটার দুই প্রান্তে লম্বা লম্বা কাঁটা থাকে। পাতার অগ্রভাগ সুচালো।

আমাদের দেশে যে খেজুর গাছ দেখতে পাওয়া যায় তার ফল গ্রামীণ জনপদে বেশ জনপ্রিয়। রসের জন্য প্রতিবছর কাটা হয়ে বলে গাছগুলো বিশেষ আকৃতি ধারণ করে। গাছ সাধারণত ৪-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফল সাধারণত বীজ প্রধান। বীজের উপর পাতলা আবরণের মতো শাঁস থাকে। কাঁচা খেজুর ‘কইস্ট্যা’ লাগলেও পাকা খেজুর বেশ মিষ্টি।

 

আমাদের দেশের খেজুর গাছগুলো ‘দেশী খেজুর, খাজুর কিংবা খেজুর’ গাছ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে ওয়াইল্ড ডেট পাম বা সুগার ডেট পাম বলা হয়। এটি Arecaceae গোত্রের উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix sylvestris.

একজন গাছি দিনে সর্বোচ্চ ৫০টি গাছে ‘ঠিলা’ লাগাতে পারেন

সারা বাংলাদেশেই খেজুর গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তবে ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া রাজশাহী ও নাটোর অঞ্চলে এ গাছের আধিক্য দেখা যায়। এ গাছ থেকে সংগৃহিত মিষ্টি রসকে খেজুর রস বলে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের সরকারি ওয়েবসাইটে এগ্রিকালচার স্পেশালিস্ট ড. এসএম আতিকুল্লাহর এক লেখায় একে ‘মধু বৃক্ষ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

খেজুর গাছ দুর্যোগ প্রতিরোধী উদ্ভিদ, প্রতিকূল পরিবেশেও এটি টিকে থাকতে পারে। রাস্তার দু’ধারে, পুকুর পাড় কিংবা ক্ষেতের আইলে এ গাছ বেশী দেখা যায়। খেজুর গাছ থেকে যারা রস সংগ্রহ করেন তাদের ‘গাছি’ বলা হয়। একজন গাছি দিনে সর্বোচ্চ ৫০টি গাছে ‘ঠিলা’ লাগাতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, মৌসুমি পেশা হিসাবে এক সময় গাছি’র খুব কদর ছিল। খেজুর ‍গুড়ের চাহিদা থাকলেও দেশী খেজুর গাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। খেজুর গাছের প্রতি এ ‘অনাগ্রহতা’ দূর না হলে হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে খেজুর গাছ।

শীতের শুরুতে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ শুরু হয়

তিনি বলেন, সাধারণত পাখির মাধ্যমে খেজুর বীজ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া মানুষের মাধ্যমেও এ বীজ ছড়িয়ে থাকে।

ড. জসীম বলেন, শীতের শুরুতে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ শুরু হয়। পুরো শীতকাল জুড়েই রস আহরণ করা হয়। শীত যত বেশী হয় রস পরিমাণে তত বেশী হয়, মিষ্টিও হয়। চৈত্র মাসে গাছে ফুল ধরে। জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে ফল পাকে।

তিনি আরও বলেন, বীজ থেকে চারা গজাতে ২-৩ মাস লাগতে পারে। এরপর অনাদর আর অবহেলায় এ গাছটি বেড়ে উঠে। স্থান ভেদে ৫-১০ বছর বয়সি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছ থেকে ৩০-৫০ বছর অব্দি রস সংগ্রহ করা যায়।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, গাছে গাছে ঠিলা লাগানো শুরু করেছেন গাছি’রা। পানীয় হিসাবে খেজুর রসের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত রস দিয়ে গুড় তৈরি করেন তারা।

রস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন গাছি

রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার গাছি মো. বিপুল বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানান, দুপুর থেকে বিকেল অব্দি গাছে ঠিলা (রস আহরণের মাটির পাত্র) লাগান গাছি’রা। সারারাত ফোঁটায় ফোঁটায় রস এ ঠিলায় এসে পড়ে। সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে রস ভর্তি এ ঠিলা সংগ্রহ করা হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে একটি গাছ থেকে ৫-৭ লিটার রস পাওয়া যায়।

আরেক গাছি হাশেম আলী সরকার বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে জানান, মূলত গুড় তৈরির উদ্দেশ্যে এ রস সংগ্রহ করা হয়। তবে পানীয় হিসাবেও এ রস খুব জনপ্রিয়। এ রস দিয়ে পিঠা, পায়েস, নলেন গুড়, পাটালি গুড় প্রভৃতি তৈরি হয়।

তিনি বলেন, গুড় তৈরি করতে প্রথমে রসটি একট পাতিলে জ্বাল দেওয়া হয়। এতে কিছু উপকরণ পরিমাণ মতো মেশানো হয়। রস ঘন হয়ে আসলে তার নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢেলে শুকিয়ে পাটালি তৈরি করা হয়।

তরুণ গাছি মনিরুল ইসলাম জানান, তিনি প্রতিদিন ৪২টি গাছ লাগান। দুপুর ১১টা থেকে বিকাল অব্দি গাছে ঠিলা লাগান তিনি। ভোর সকালে এ ঠিলা গাছে থেকে নামিয়ে রস সংগ্রহ করেন।

শুধু মানুষই এ রসের ভক্ত নন। এ রসে ভাগ বসায় দোয়েল, বুলবুলি, শালিক পাখিসহ অন্যান্য পাখি, পিঁপড়া ও মৌমাছিরাও। তাই সরাসরি কাঁচা রস খাওয়া ঠিক নয়। এতে প্রাণঘাতি নিপাহ ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর