মীরজাফরের হালনাগাদ সালতামামি

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 09:46:12

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পর পরবর্তী সময়ে মীর জাফরসহ তার বংশধররা নবাবী পদ অলঙ্কৃত করলেও তারা ছিলেন নামমাত্র নবাব। ইংরেজরা তাদের হাতে কোনো ক্ষমতায় দেয়নি বরং পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতার নজরানাস্বরূপ তাদের ভাগ্যে জুটেছিল আর্থিক সুবিধা। বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেশের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে সে অর্থে তারা শুধু ভোগবিলাসই করে গেছেন। বাংলা প্রায় ২শ’ বছরের জন্য স্বাধীনতা হারিয়েছিল। বাংলার মানুষের ভাগ্যে নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। জাতির গলায় পরাধীনতার জিঞ্জির তুলে দিয়ে মীরজাফর ও তার বংশের কথিত নবাবরা ইনাম হিসেবে যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে তারা ইন্দ্রিয়বিলাসই করে গেছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনকে উপভোগ করেছেন। সাধারণ মানুষকে নিয়ে তাদের পক্ষে ভাববার কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু সেসবও বেশি দিন নয়। সেসবের জৌলুসও ফুরায়। কেড়ে নেওয়া হয় ‘নবাবী’ খেতাব। শুরু হয় মীরজাফরের বংশধর হিসেবে ঘৃণা পাওয়ার পালা। ফলে বর্তমানে মীরজাফরের বংশধরেরা নিরুপায় হয়ে যে যেখানে পারেন সেখানেই নিজের পরিচয় গোপন করে বেঁচে থাকেন। এদের মধ্যে কেউ ঠাঁই নিয়েছিলেন পাকিস্তানে। কেউ ভারতে। তারও আগে ছিল নবাবী বংশ থেকে বাঈজী বংশে পরিণত হওয়ার করুণ গল্প।

নবাব বংশ থেকে বাঈজী বংশ

নবাব আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমের গর্ভজাত এবং মীর জাফরের ঔরসজাত সন্তান মীর সাদেক আলী খান মিরনের বজ্রপাতে মৃত্যু হলে সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের কথিত নবাবী। ১৭৬৫ সালে মীরজাফরের মৃত্যুর পর তার ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈয়ের গর্ভজাত নজমউদ্দৌলাকে (১৭৬৫-৬৬ খ্রিঃ) কোম্পানি বাংলার নবাব বানায়। ঐতিহ্যবাহী বাংলায় শুরু হয় বাঈজী বংশের তথাকথিত নবাবী। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বব্বু বাঈও ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। নবাব মাতা হতে তিনিও বাদ পড়েননি। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বব্বু বাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারক উদ্দৌলা (১৭৭১-৯৩)। মুন্নী বাঈয়ের চাইতে বব্বু বাঈ ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। মুন্নী দেখতে সুন্দরী ছিলেন। তার চেয়েও সুন্দরী ছিলেন আন্নাবাঈ। রাজস্থানে তিনি নেচে রোজগার করেছেন মৃত্যুর আগে অব্দি।

নবাব আলীবর্দী খান


মুর্শিদাবাদের নবাবী খেতাব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা

তবে মুর্শিদাবাদের নবাবী খেতাব ফিরে পাবার জন্য মীর জাফরের বংশধররা আদালতে যে দীর্ঘ আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন সে লড়াইয়ে তারা প্রাথমিকভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। তারা ফিরে পাননি নবাবী খেতাব। আসলে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবেই লর্ড ক্লাইভ মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের নবাবের আসনে বসিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মীর জাফরের পরিবারকেই নবাবের স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর ১৯৬৯ সালে কলকাতায় মারা গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদেরর শেষ নবাব ওয়ারিশ আলি মীর্জা। এই সময়ই ভারত সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের উত্তরসুরী কে তা জানতে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। তা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আর এখন পর্যন্ত সে ধারাটিই বিশ্বাসঘাতকতার সুবিধাভোগী ও খেতাবধারী। এর কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার হাজার দুয়ারিসহ মুর্শিদাবাদের নবাবের সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নেয়। নবাবী খেতাবও হারান মীর জাফরের উত্তরসূরীরা।

কেমন আছেন বংশধরেরা

মির্জা জাফর আলম: পলাশীর যুদ্ধের আড়াইশ’ বছর পরেও বিশ্বাসঘাতকতার অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলেনি মীর জাফরের বংশধরদের। পূর্বপুরুষদের বিশ্বসঘাতকতার গ্লানি এখনো বংশ পরস্পরায় বয়ে যাচ্ছেন তারা। লজ্জায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন না। গোপন রাখেন আত্মপরিচয়। ভারতের মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে আছে মীর জাফরের বংশধররা। জানা গেছে, কোনো এলাকায় তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে তারা অন্য এলাকায় পাড়ি জমান। মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের প্রাসাদের প্রধান গেটটি আজও ‘নেমক হারাম দেউরি’ নামে পরিচিত। এখানকার কবি সলিল ঘোষ জানান, এলাকাবাসী ‘নেকম হারাম দেউড়ি’-তে ঢুকে মীর জাফরের বংশধরদের গালাগাল করত। টিকতে না পেরে তারা বিভিন্ন এলাকায় পরিচয় গোপন করে বসবাস করছে। এটি দুঃখজনক। কারণ মীরজাফরের অপরাধের দায় কেন নেবেন তার বংশধরেরা। সলিল ঘোষের সহপাঠী জাফর আলম মির্জা হচ্ছেন মীর জাফরের অষ্টম বংশধর। এখন ‘নেকম হারাম দেউড়ি প্রাসাদ ছেড়ে হাজার দুয়ারী এলাকায় বসবাস করছেন। জাফর আলম মির্জা একসময় শিক্ষকতা করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। শিক্ষকতা করার সময়ও অনেক শিক্ষার্থী তাকে কটুক্তি করত। তিনি একটি বইও লিখেছিলেন। সে বইয়ের নাম, ‘আমি মীরজাফর না।’ পরে সমালোচনা মুখে এ বইটি জাফর আলম মির্জা বাজার থেকে তুলে নেন।

সলিল ঘোষ বলেন, এই বংশের ওপর সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খারাপ। এমনকি এই বংশের ভালো লোকগুলোকেও এখন কেউ বিশ্বাস করে না। এই কলঙ্ক থেকে বাঁচতে একটি বই লিখেছিলেন জাফর আলম। এই বইয়ে তিনি বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। এ নিয়ে বেশ তোলপাড় হলে বইটি বাজার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। মির্জা জাফর আলম আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ। তাকে নিয়ে আমি আনন্দবাজারেও লিখেছি।’

ইস্কান্দার মির্জা: পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অবৈধ ভূমিকার কুশীলব হিসেবে ভাবা হয় মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের পা-চাটা সামরিক অফিসার ছিলেন তিনি। বেসামরিক আমলা হিসেবেও অভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সবারই জানা, পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হয়েছিলেন তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের কারসাজিতে। নবাব বাহিনীর বড় অংশ যুদ্ধে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে ইংরেজের বিরুদ্ধে। ফলে শক্তির বিচারে ইংরেজের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও নবাব বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এ পরাজয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তার স্বাধীনতা হারায়। বিশাল এ ভূখণ্ডে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়। বিশ্বাসঘাতকতার এনাম হিসেবে মীরজাফর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তবে তিনি ছিলেন ক্ষমতাহীন। দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সহায়তা করা ছিল তার একমাত্র দায়িত্ব। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই পলাশী যুদ্ধের পর কালক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন মীরজাফরের চতুর্থ অধস্তন বংশধর। মীরজাফর ইস্কান্দার মির্জার দাদার বাবা।

ইস্কান্দার মির্জার জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৩ মে। তবে তার শৈশব কেটেছে ভারতের মুম্বাই নগরীতে। মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজে তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ১৯১৮ সালে স্যান্ডহার্স্টে রয়্যাল মিলিটারি একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। ১৯২০ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। একই বছর তিনি ক্যামেরোনিয়ান দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত হন। তিনি ১৯২১ সালে কোদাদ-খেল ও ১৯২৪ সালে ওয়াজিরিস্তানে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ১৯২৬ সালে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে ভারতীয় পলিটিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে অ্যাবোটাবাদ (১৯২৬-২৮), বান্নু (১৯২৮-৩০), নওশেরা (১৯৩০-৩৩) ও টল্কে (১৯৩৩) এবং ডেপুটি কমিশনার পদে হাজারা (১৯৩৩-৩৬) ও মর্দানে (১৯৩৬-৩৮) দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি খাইবারে (১৯৩৮-৪০) পলিটিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, পেশোয়ারে ডেপুটি কমিশনার (১৯৪০-৪৫) এবং উড়িষ্যায় পলিটিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ পদে (১৯৪৫-৪৬) কাজ করেন। ইস্কান্দার মির্জা ১৯৪৬ সালে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব এবং দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব নিযুক্ত হন। পূর্ববাংলা প্রদেশে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল ও গভর্নর জেনারেলের শাসন জারির পর তিনি ’৫৪ সালের ৩০ মে গভর্নর নিযুক্ত হন। গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পরপরই ইস্কান্দার মির্জা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি এক মাসের মধ্যে ৩৩ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপকসহ ১ হাজার ৫১ জনকে গ্রেফতার করেন। সভা ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। গভর্নর হাউসকে সুসজ্জিত করেন এবং নাচ-গানসহ সেখানে প্রায় নিয়মিত জাঁকজমকপূর্ণ নৈশভোজের আয়োজন করতেন।

১৯৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত এলাকা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। ৫৫ সালের ৫ আগস্ট অসুস্থতার জন্য পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ছুটিতে গেলে তিনি প্রথমে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল এবং পরে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের ’৫৬ সালের প্রথম সংবিধান অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল পদকে প্রেসিডেন্ট পদে রূপান্তর করা হয় এবং ইস্কান্দার মির্জা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অভিযোগে তিনি ’৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এর মাত্র ২০ দিন পর আইয়ুব খান এক রক্তপাতহীন সামরিক ক্যুর মাধ্যমে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। তিনি ইস্কান্দার মির্জাকে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠান। ’৬৯ সালের ১২ নভেম্বর ইস্কান্দার মির্জা লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার তার লাশ পাকিস্তানে সমাহিত করতে অনুমতি দেয়নি। সে কারণে তার মৃতদেহ তেহরানে নিয়ে যাওয়া হয়। ইরানের শাহ একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় তার মৃতদেহ রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর