ভারতবর্ষের জন্য জীবন উৎসর্গ করা প্রথম ভিনদেশি নারী

, ফিচার

ওসমান জাফর, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-29 14:49:23

ভারতবর্ষের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এরকম বিদেশি মহৎপ্রাণ অনেকেই আজ বিস্মৃত। তাঁদেরই একজন অ্যাংলো আইরিশ—মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। যিনি ভারতবর্ষে এসে ‘ভগিনী নিবেদিতা’ বা সিস্টার নিবেদিতা নাম গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ভিনদেশি নারী যিনি বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে মানবসেবার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের আসেন এবং সন্ন্যাসব্রত পালন করেন।

১৮৯৫ সালে লন্ডন শহরে নভেম্বর মাসে এক পারিবারিক আসরে স্বামী বিবেকানন্দের দেখা পান মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। স্বামী বিবেকানন্দ তখন লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় নিজের মহৎ বাণীর কথা প্রচার করার জন্য বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি প্রচার করছেন বেদান্ত দর্শন, ধর্মব্যাখ্যা। স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার ক্লাসে প্রশ্ন-উত্তর তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং এসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন।

মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতায় মুগ্ধ হন এবং স্বামীজির বাণী তাঁর হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি স্বামীজির ব্যক্তিত্বেও অভিভূত হন। তখনই তিনি মানবসেবাকে মনেপ্রাণে গ্রহণের ইচ্ছায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তিনি তখন যুবতী। বয়স মাত্র ২৯। ১৭ বছর বয়সে পড়ালেখা শেষ করে ১৮৮৪-১৮৯৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি পড়াশোনা করছিলেন বুদ্ধধর্মের ওপর। এছাড়া তাঁর পিতা স্যামুয়েল রিচমেন্ডের ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবও তাঁর ওপর বর্তেছে। পিতা স্যামুয়েল রিচমেন্ড সবসময় বলতেন, মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা। এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দ মারফত ভারতবর্ষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে তিনি ভারতবর্ষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

পিতা স্যামুয়েল রিচমেন্ডের ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবও তাঁর ওপর বর্তেছে

স্বামী বিবেকানন্দের সাথে ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে মোলাকাতের পর ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি লন্ডন ছেড়ে ভারতবর্ষে আসেন। সে বছরই ২৫ মার্চ তিনি ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করলে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নামকরণ করেন ‘নিবেদিতা’।

জীবনের প্রথম পর্ব
১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম ছিল মেরি ইসাবেলা। মাত্র দশ বছর বয়সে মার্গারেটের বাবা মারা যান। তারপর তার দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাকে লালনপালন করেন। মার্গারেট লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর হ্যালিফ্যাক্স কলেজে তিনি এবং তাঁর বোন মেরি পড়াশোনা করেছিলেন।

১৮৮৪ সালে, সতের বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। দু বছরের জন্যে কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপরে একে একে রেক্সহ্যামে (১৮৮৬), চেস্টারে (১৮৮৯) এবং লন্ডনের উইম্বলডনে (১৮৯০) তিনি শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন পরে ১৮৯৫ সালে উইম্বলডনে নিজে ‘রাস্কিন স্কুল’ উদ্বোধন করেন। তিনি এই স্কুলে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করেন। পাশাপাশি নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে ও গির্জার হয়ে নানা সেবামূলক কাজও শুরু করেন। তিনি একজন ওয়েলশ যুবকের কাছে বিবাহের প্রতিশ্রুতি পান, কিন্তু সে যুবক অচিরে মারা যান।

কলকাতা পর্ব
১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি লন্ডন ত্যাগের পর তিনি উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনে একটি বাসা নেন। তারপর মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য সে বাসাতেই তিনি মেয়েদের একটি স্কুল খোলেন। এখন যার নাম রামকৃষ্ণ সারদা মিশন ভগিনী নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় মহামারী দেখা দিলে তিনি স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় রোগীদের সেবাশুশ্রুষা ও পল্লী-পরিষ্কারের কাজ করেন।

১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি কলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দু রক্ষণশীল পরিবার থেকে ছাত্রী সংগ্রহের কাজ করতেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা মানবকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সকল বর্ণের ভারতীয় নারীর জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু ও তার স্ত্রী অবলা বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওকাকুরো কাকুজো প্রমুখ তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছিলেন নিবেদিতার বন্ধুস্থানীয়। রবীন্দ্রনাথ তাকে ‘লোকমাতা’ আখ্যা দেন। ভারতীয় শিল্পকলার সমঝদার নিবেদিতা ভারতের আধুনিক চিত্রকলা সৃষ্টিতেও অন্যতম অনুপ্রেরণার কাজ করেন।

সারদা দেবীর সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা 

নন্দলাল বসু এই কথা একাধিকবার স্মরণ করেছেন, জীবনের শেষ পর্বে নিবেদিতা এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকার যাতে রামকৃষ্ণ মিশনকে অযথা উত্ত্যক্ত না করে, সেই কথা ভেবে মিশনের সঙ্গে তিনি তাঁর ‘আনুষ্ঠানিক’ সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কারণ ভগিনী নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের রাজকৃষ্ণ পরহংসের সহবত লাভ করে তাঁকে ভগবানতুল্য ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন ও মিশনের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই সিস্টার নিবেদিতার গুরু স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়।

সিস্টার নিবেদিতা

তিনি বিট্রিশ সরকারের ভারতীয়দের প্রতি অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম-দুঃশাসনের কারণে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিয়মানুসারে ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রব ঠেকাতে সংঘের কেউ রাজনীতিতে জড়াতে পারত না। তাই মিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ত্যাগ করতে হয় নিবেদিতাকে। যদিও সারদা দেবী ও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি ভারতবর্ষে কলেমার মহামারী দমনেও উদ্যোগী হন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে শুরু করেন নিবেদিতা। এই সময় অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এসবের পাশাপাশি নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা, ডন, প্রবুদ্ধ ভারত, বালভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, শিল্প ইত্যাদিতে বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন।

প্রভাব
ভগিনী নিবেদিতা ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর বই মাতৃরূপা কালী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ ছবিটি আঁকেন। বিধাননগরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০১০ সালে নির্মিত ভবনটি নিবেদিতার নামে নামাঙ্কিত।

তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে ভগিনী নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিটির নাম রাখা হয়েছে সিস্টার নিবেদিতা অ্যাকাডেমি। তার নামে একাধিক বিদ্যালয় ও কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার তার স্মৃতিরক্ষার্থে ৪.০৬ X ২.২৮ সেন্টিমিটারের একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

লেখালেখি
সিস্টার নিবেদিতা পত্রিকায় কলাম ও ইংরেজিতে অনেক বই লিখছেন। ভগিনী নিবেদিতার বইগুলির মধ্যে দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ (এই বইতে নিবেদিতা ভারতীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে পাশ্চাত্যে প্রচলিত নানা ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করেন), মাতৃরূপা কালী , স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি , স্বামীজির সহিত হিমালয়ে, ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম, স্টাডিজ ফ্রম অ্যান ইস্টার্ন হোম, সিভিল আইডিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশানালিটি, হিন্টস অন ন্যাশানাল এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া, গ্লিম্পসেস অফ ফেমিন অ্যান্ড ফ্লাড ইন ইস্ট বেঙ্গল-১৯০৬ উল্লেখযোগ্য।

মৃত্যু
ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন নিবেদিতা। হাওয়া বদলের জন্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যান নিবেদিতা। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিংয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৪ বছর। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর। ১৮৯৮ থেকে ১৯১১ সাল—এ তের বছর কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না তিনি করেছেন, অথচ তিনি আজ বিস্মৃতপ্রায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর