মিথ্যা নির্ণয়ের বৈজ্ঞানিক উপায়

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 09:21:15

কিছু মানুষ আছে যারা মিথ্যে বললে খুব সহজে বোঝা যায়। আবার কিছু মানুষ আছে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। একটা মিথ্যাকে এত সুন্দর এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে যে কেউ ভাবতেই পারে না এটা মিথ্যা ছিল। এসব লোকেদের ফাঁদে পড়ে অনেকেই বিপদে পড়েন। কিন্তু একটু সচেতন হলেই কে সত্য বলছে আর কে মিথ্যা, তা নির্ণয় করা যায়। আর সেই কাজটি আরো সহজ করে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত একটি গবেষণা। বিজ্ঞানীদের একটি দল মানুষের কথাবার্তা এবং আচার-আচরণের ওপর দীর্ঘ গবেষণা করে কিছু মাপকাঠি নির্ণয় করেছেন যেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই নির্ণয় করে ফেলা যায় কে মিথ্যে বলছে, আর কে সত্য।

মানুষ কথা বলতে গিয়ে সময়ে-অসময়ে আশ্রয় নেয় মিথ্যার। অপরদিকে অনেকেই মিথ্যার দ্বারা প্রতারিত হয়ে একটা সময় ভাবতে বাধ্য হয়—যদি এমন কিছু পাওয়া যেত যা দিয়ে সহজে মিথ্যাগুলো আলাদা করা যায়! কিন্তু বাস্তবে যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায় না তাই মিথ্যাগুলো ধরতে না পেরে পদে পদে প্রতারিতই হয় তারা। একজনের একটি মিথ্যা আরেকজনের প্রাণনাশেরও কারণ হয়ে ওঠে কখনো।

তবে শুধু মানুষ না, অন্য প্রাণীদের মধ্যেও আছে মিথ্যা বলার প্রবণতা। মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান এবং তার দল একটি গবেষণার মাধ্যমে প্রাণীদের মধ্যেও মিথ্যার প্রবণতা দেখেছেন। তারা দেখেন, মোরগগুলো এমনভাবে আওয়াজ করে খাবারের মিথ্যা প্রলোভন দেখায় যে মুরগিগুলো তা শুনে ছুটে আসে। এরপর তাদের খাবারের পরিবর্তে যৌনকার্যে বাধ্য করে।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মিথ্যা বলার অভ্যাস নিয়ে বিব্রত হয়ে আছে। আর তাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ মিথ্যা এবং মিথ্যাবাদীকে আলাদা করার চেষ্টা করে আসছে। পশ্চিম আফ্রিকায় একসময় মিথ্যাবাদী ধরা হতো পাখির ডিম দিয়ে। সন্দেহভাজনদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হতো এবং তাদের হাতে তুলে দেওয়া হতো পাখির ডিম। এই পাখির ডিম একে একে হাতবদল হতো। হাতবদল হওয়ার পথে যার হাতে ডিমটি ভাঙত, সে-ই মিথ্যাবাদী বলে বিবেচিত হতো। প্রাচীন চীনে অবশ্য পাখির ডিমের বদলে ব্যবহার করা হতো একমুঠো চাল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চিবোতে দেওয়ার পর যার মুখে চাল শুকনো থাকবে, সে-ই নাকি মিথ্যাবাদী! মিথ্যাবাদী নির্ণয়ে চালপড়া দেওয়ার প্রচলন অবশ্য আছে আমাদের দেশেও।

এখনকার এই দিনে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন টেকনোলোজি অনেক এগিয়েছে যেহেতু, সেহেতু এমন কিছু একটা নিশ্চয় বেরিয়েছে যা দিয়ে খুব সহজে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা যাবে। কিন্তু বাস্তব কথা হলো বিজ্ঞান এখনো এতটা অগ্রসর হয়নি। তবে বিজ্ঞান যে থেমে আছে তাও না। বিজ্ঞান এমন কিছু পদ্ধতি বাতলে দিচ্ছে যা আপনাকে খুব সহজে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে শেখাবে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী যে পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞান আমাদের অবহিত করে সেটি হলো আপনি কিভাবে একজনকে একটা প্রশ্ন করেন আর সে তার জবাব ঠিক কিভাবে আপনার কাছে পৌঁছে দেয় এই ব্যাপারটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।

ব্যক্তির শারীরিক ভাষায় কি প্রকাশিত হয় যে সে মিথ্যা বলছে?
ব্যক্তির শারীরিক ভাষায় প্রকাশ হয় কিনা যে সে মিথ্যা বলছে, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিজ্ঞাসা। এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে আরেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দরকার। অনেকেই ‘লাই ডিটেক্টর’ মেশিনের সাথে পরিচিত। বেশ কিছু ক্যাবল টিভির রিয়েলিটি শোতে এটা ব্যবহার করার ফলে অনেকেরই মেশিনটি নিয়ে অল্পবিস্তর ধারণা আছে। লাই ডিটেক্টর নামে আমরা যে জিনিসটিকে চিনি তার নাম পলিগ্রাফ। পলিগ্রাফ মেশিনটি বাস্তব জীবনে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থা যেমন এফবিআই এবং সিআইএসহ অনেকেই ব্যবহার করে থাকে। তারা এটি কেবল অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য নয়, বরং কর্মসংস্থানে স্ক্রিনিংয়ের জন্যও ব্যবহার করে। পলিগ্রাফ হার্ট রেট, রক্তচাপ, ঘাম এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হারসহ শারীরিক লক্ষণগুলো পরিমাপ করে একটি ফলাফল প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায় মিথ্যাচারী লোকেরা এটি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকে এবং তাদের শরীরের নানান আচরণের মাধ্যমে তাদের মিথ্যাবাদিতা সামনে চলে আসে।

লাই ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষাটি খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়

এখন আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এফবিআই, সিএআই এবং এই জাতীয় হাই-প্রোফাইল সংস্থাগুলি যেহেতু এটির ওপর তাদের আস্থা রাখে তাই এটি অবশ্যই নির্ভরযোগ্য, তাই না? আসলে কিন্তু তা নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়টি অনেকেই জানেন যে এটি পুরোপুরি কাজ করে না। আসল যে কাজটা এই যন্ত্র করে তা হলো এই পদক্ষেপগুলো দেখায় যে কেউ উদ্বিগ্ন কিনা। কিন্তু উদ্বিগ্ন থাকা মানেই মিথ্যা বলা, এই কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। অনেক সত্যবাদী ব্যক্তিও জিজ্ঞাসাবাদের সময় উদ্বিগ্ন হন, তাই পরীক্ষাটি খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়। আর আগেই তো বলেছি কিছু লোক আছেন যারা একদম স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রকার উদ্বিগ্ন না হয়েই মিথ্যা বলতে পারে। তাই এই পরীক্ষা তাদের জন্য খুব একটা কাজের না। তবে মিথ্যা বলার সময় মানুষের শরীরে বিশেষ করে হাত, চোখ এবং কথা বলার ধরণে কিছুটা পরিবর্তন আসে সত্যি।

কারো মিথ্যা ধরতে হলে নিজের কান-দুটো ব্যবহার করুন
আপনি যদি শ্রোতা হিসেবে মনোযোগী হন তবে মিথাবাদী শনাক্তকরণে আপনি এগিয়ে আছেন। কেননা মিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মনোযোগী হয়ে কথা শোনার কোনো বিকল্প নেই। একজন অপরাধীর মতো একজন মিথ্যাবাদীও যখন কোনো মিথ্যা বলে তখন নিজের অজান্তে এমন কিছু প্রমাণ রেখে যায়, যা তার জন্য কাল হয়। প্রায়শই খেয়াল করবেন যখন কোনো মিথ্যা গল্প আপনাকে শোনানো হয় তখন দেখা যায় এগুলোতে অল্পবিস্তর গড়মিল থেকে যায়। একটা ঘটনা আরেকটা ঘটনার সাথে খুব গভীরভাবে কানেক্টেড থাকে না। কোথাও না কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকেই যায়।

চোখ যে মনের কথা বলে
মানুষ যখন মুখ দিয়ে মিথ্যে বলে তখন শরীরের একটা অঙ্গ বিশেষভাবে তা প্রমাণ করে। আর তা হলো মানুষের চোখ। এফবিআই কর্মকর্তা মার্ক বুটন বলেন, মানুষ যখন কোনো বিষয় বলতে গিয়ে অস্বস্তি অনুভব করে, তখন তার চোখের মণি এদিক–সেদিক নড়াচড়া করে। এর দ্বারা বোঝা যায়, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছে না। যখন কেউ মিথ্যা বলে, তখন সে পরপর পাঁচ–ছয়বার খুব দ্রুত চোখের পাতা ফেলতে পারে। মার্ক বুটনের মতে, সাধারণত মানুষ প্রতি মিনিটে পাঁচ থেকে ছয়বার, অর্থাৎ প্রতি ১০ থেকে ১২ সেকেন্ডে একবার চোখের পাতা ফেলে।

কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে হয় অন্যদিকে তাকিয়ে।” তাই যার সাথে কথা বলছেন সে কতটা সত্যবাদী তা নির্ণয়ে চোখের ভূমিকা অনেক।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কাডির মতে, সামনের মানুষটি মিথ্যা কথা বলছেন কিনা, সেটা ধরার জন্য খেয়াল করুন তার কথার সঙ্গে চেহারার অভিব্যক্তির মিল আছে কি নেই। এমন ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় মিথ্যাবাদী ব্যক্তির গলায় হয়তো খুশির আভাস দেখা যায়, কিন্তু চেহারায় থাকে দুশ্চিন্তার ঝলক।

এছাড়াও অনেকে মিথ্যা কথা বলার সময় কৃত্রিম হাসি দিয়ে শ্রোতাকে আশ্বস্ত করতে চায় বা তার বিশ্বাস অর্জন করতে চায়। আরেকটি ব্যাপার হলো যখন মিথ্যাবাদী তার কথা কন্টিনিউ করতে গিয়ে আটকে যায় তখন সে নতুন কথা তৈরি করার জন্য সময় নেয়। কথা বলার সময়ে প্রায়ই কাশি দিয়ে কিংবা নাক মুখ চুলকিয়ে সে কালক্ষেপণ করে। কেননা মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের শরীরে একধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে মুখমণ্ডল চুলকাতে থাকে। ফলে মিথ্যা বলার সময় মানুষকে ঘন ঘন নাকের ডগা, গাল বা ঘাড় এবং মাথা চুলকাতে দেখা যায়।

যারা বেশি মিথ্যা কথা বলে, তারা মিথ্যা বলে ধরা পড়ার উপক্রম হলে প্রায় সময়ই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। খেয়াল করলেই দেখবেন অনেকেই মিথ্যা বলার সময় হুট করে রেগে যায়, চেঁচামেচি শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে এই যে, তাদের রাগ দেখে আপনি হয়তো প্রশ্নটা পরে করবেন বা একসময় ভুলে যাবেন। কিংবা তাদের রাগ থামানোর জন্য প্রসঙ্গই বদলে ফেলবেন।

এই ঘটনাবহুল জীবনে যারাই মিথ্যার দ্বারা আহত হয়েছেন, একটু সতর্ক হলে এবং উপরের বিষয়গুলো একটু ভালোভাবে অনুধাবন করলে ভবিষ্যৎ পথচলা হয়তো আরেকটু মসৃণ হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর