স্যার ফজলে হাসান আবেদ কে ছিলেন

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 22:55:01

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। মুক্তিযুদ্ধের বারুদ ও বোমার গন্ধ বাতাস থেকে তখনও সরে যায়নি। বাংলার জনপদে তখনও থমথমে গুমোট ভাব। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা শিশু রাষ্ট্রের পক্ষে সেই সময় জনতার প্রয়োজন কতটুকু মেটানো সম্ভব? তারপরেও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নতুন সরকার। ঠিক সেই সময় সিলেটের শাল্লায় যুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষের জন্য সহায়তা দিতে কাজ শুরু করেন মাঝবয়েসী এক তরুণ। মানুষের অবস্থা নিজের চোখে দেখার সেই অভিজ্ঞতা তাকে আমূল বদলে দেয়। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি। ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সাল থেকে পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে কাজ শুরু করে। নাম বদল করে রাখা হয় বাংলাদেশ রুরাল এডভান্সমেন্ট কমিটি। এই সেই ব্র্যাক। আর প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিটিই ফজলে হাসান আবেদ। একজন বর্ণিল কর্মমুখর জীবনের নায়ক। তার উদ্দীপনা আর দরদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘ব্র্যাক’ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা।

ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল। জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সমাপ্ত করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য যান। গ্লাসগোতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হলেও সেটা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টস-এ ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করে যোগ দেন শেল অয়েল কোম্পানিতে।

১৯৭০ সালের নভেম্বরে পূর্ব-পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। জন্মস্থানের টান উপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। বন্ধুদের নিয়ে ‘হেল্প’ নামে সংগঠন গড়ে তুলে মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে দাঁড়ান। পরিচালনা করেন ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আবেদ ছিলেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু শুধু চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ এবং জনমত গঠনে কাজ করেন।

শিক্ষা কার্যক্রমে স্যার ফজলে হাসান আবেদ

সত্যি কথা বলতে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্র্যাক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজ করার পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত। দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি কয়েকটি ধাপে অগ্রসর হন। প্রথম দিকে পুনর্বাসনের কাজে অগ্রাধিকার দিলেও পরে শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুহার কমানোর জন্য এগিয়ে এলেন। পরের দফাতেই হাত দিলেন নারীর ক্ষমতায়নের পথে। ব্র্যাক যখন সত্যিকার অর্থেই দাঁড়িয়ে গেছে, তখন মনোযোগ দেওয়া হলো ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দক্ষতা তৈরির কাজ। নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায়ের কারণে তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কাজের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে সমাজে তার প্রভাব।

গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য আশির দশকের শেষের দিকে আড়ং প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। দেশজ নকশা ও কাপড়, দেশীয় তামা, কাঠ ও পুঁতির গয়না নতুন করে প্রচলন করা হয় বাঙালির বাজারে। নাগরিক সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে দেশীয় সিল্ক ও রূপার গয়না। কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণের কথা মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক ব্যাংক। এরপর আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাল আমলের মোবাইল ব্যাংকিং ‘বিকাশ’।

নারী ক্ষমতায়নে তার ব্যস্ততা ছিল সারাজীবন

২০০০ সাল। ফজলে হাসান আবেদ তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। অ্যাপলের স্টিভ জবসের সাথে ডিনারের সময় জবস তার পদ্ধতির প্রশংসা করলেন—“তোমার মডেলটা এত ভালো; তুমি দেশের বাইরে কেন কাজ করছো না?” কথাটা তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। বদলে দেয় ব্র্যাকের ভবিষ্যতও।

২০০২ সালে আফগানিস্তানের যুদ্ধ বিপর্যস্ত অবস্থায় জাতিসংঘ আহবান করেছিল কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে দায়িত্ব নেবার জন্য। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কেউ সাড়া দেননি সেদিন। কিন্তু মানবিক দায়কে জলে ফেলতে পারেননি স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তার এই দুঃসাহসিকার জন্য সফলতাও আসে মুঠো ভরে। বর্তমানে ব্র্যাকের কর্মীর সংখ্যা কেবল বাংলাদেশেই এক লক্ষের উপরে। বিশ্বের অনেক দেশই দারিদ্র্য বিমোচনে ব্র্যাকের মডেল অনুসরণ করছে।

‘নাইটহুড’ উপাধিসহ পান দেশি ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা

দারিদ্র্য বিমোচন, বিশেষত নারী ও শিশুদের জীবন-মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের সম্মানসূচক ‘নাইটহুড’ উপাধি। তার পাওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রিগুলো হলো—
• ১৯৯৪ কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
• ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন ডিগ্রি।
• ২০০৭ যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স ডিগ্রি।
• ২০০৮ যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
• ২০০৯ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স ডিগ্রি।
• ২০০৯ জাপানের রিক্কিও ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটার্স ডিগ্রি।
• ২০১০ যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
• ২০১২ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি।
• ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ ডিগ্রি।
• ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব দি সাউথ থেকে ডক্টর অব সিভিল লজ ডিগ্রি।
• ২০১৬ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্র্যাডফোর্ড থেকে ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর