বাঙালি হৃদয়ে চির অম্লান জর্জ হ্যারিসন

, ফিচার

নিশীথ দাস, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 19:19:40

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে একটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়, যার নাম ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, আন্তর্জাতিক সচেতনতা এবং ত্রাণ তহবিল বাড়ানো। এ কনসার্ট আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পাঁচ সপ্তাহ সময় লাগে। এর পেছনে যার ভূমিকা অগ্রগণ্য তিনি জর্জ হ্যারিসন। আর যার অনুপ্রেরণায় তিনি এমন কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হন তিনি ভারতের বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যায় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রীর অভাব দেখা দেয়। তাছাড়া এর আগে ১৯৭০ সালে ভোলার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বেশিরভাগ মানুষই বিপদাপন্ন ছিল। এসব বিষয়ে রবি শংকর জর্জ হ্যারিসনের সাথে আলাপ করেন। ত্রাণ সংগ্র্রহের জন্য তিনি হ্যারিসনকে আমেরিকায় একটি কনসার্ট আয়োজনের কথা বললে হ্যারিসন রাজি হয়ে যান।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশের দুই সংগঠক জর্জ হ্যারিসন এবং রবি শংকর

এ কনসার্টটিতে পরিবেশিত গানগুলো হলো—ওয়াহ ওয়াহ, সামথিং, দ্যাট’স দ্য ওয়ে গড প্লেনেড ইট, ইট ডোন্ট কাম ইজি, বিওয়ার অব দ্য ডার্কনেস, হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস, জাম্পিন জেক ফ্লাশ, ইয়ংব্লাড, হেয়ার কামস দ্য সান, অ্যা হার্ড রেইন’স অ্যা গোন্না ফল, প্লেইন ইন দ্য উইন্ড, ইট টেকস অ্যা লট টু লাভ-ইট টেকস অ্যা ট্রেন টু ক্লাই, জাস্ট লাইক অ্যা উইমেন, মাই সুইট লর্ড, অ্যাওয়েটিং অন ইউ, অল, লাভ মাইনাস জিরো, হেয়ার মি লর্ড, মি. টাম্বোরিন ম্যান।

কনসার্টের ইতি টানা হয় জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ দিয়ে। এ কনসার্টের জন্য গানটি বিশেষভাবে রচিত হয়। কথা ও সুর জর্জ হ্যারিসনের নিজের। আর এ কনসার্ট থেকে ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হয়েছিল।

‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি কনসার্ট ফর বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে রচিত

কনসার্টে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন কমলা চক্রবর্তী, রিঙ্গো স্টার, লিয়ন রাসেল, বিলি প্রিস্টন, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, ক্লস বোরম্যান, জিম কেল্টনার, ব্যাড ফিঙ্গার, পিটি হাম, টম ইভান্স, জোরি মোলাও, মাইক গিবসন, জেসি অ্যাড ডেভিস, ডন প্রিস্টন, ডন নিক্স, জো গ্রিন, মার্লিন গ্রিন, ডলরেস হল, ক্লডিয়া লিনিয়ার প্রমুখ। সেতারবাদক রবি শংকর ও বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আলি আকবর খানের যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে কনসার্ট শুরু হয়। তাদের সাথে তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। তারা বাংলা ধুন নামে একটি ধুন পরিবেশন করেন।

আই মি মাইন বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, “মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, ‘ও, হ্যাঁ, এখনো এটা চলছে।’ আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যাঁরা বলেন, ‘ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।”

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে জর্জ হ্যারিসনের সাথে গাইছেন বব ডিলান

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববাসী ভালোভাবে জেনেছিল, সভ্যতার ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে একটি দেশ। সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছের মানুষ জর্জ হ্যারিসন। তার এ কনসার্টের ফলে বাংলাদেশ অনেক প্রচার পেয়েছিল, পরবর্তীতে ঘটনাপ্রবাহ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত করতে এ কনসার্ট অনন্য ভূমিকা রাখে। হ্যারিসন বাংলাদেশের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা না হলেও গিটার আর গান দিয়ে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

জর্জ হ্যারিসন ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নাম হ্যারোল্ড হার্গ্রিভিস হ্যারিসন এবং মায়ের নাম লুইসে। তিনি বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি সঙ্গীত পরিচালনা, রেকর্ড প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার বিখ্যাত ব্যান্ড সঙ্গীত দল ছিল দ্য বিটল্‌স।

এ সম্পর্কিত আরও খবর