সোলেমানি হত্যার পর কী অপেক্ষা করছে

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-30 21:33:56

শুক্রবার বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন রকেট হানায় নিহত হলেন ইরানি সেনা রেভোলিউশন গার্ড কোরের জেনারেল কাসেম সোলেমানি। আলজাজিরা.কম-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, পেন্টাগন এই খবরের সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ইরানের ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিকল্পনা রদ করতেই এই আক্রমণ চালিয়েছিল আমেরিকা। ইরাকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেনারেল কাসেম সোলেমানি ছাড়াও ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহানদিসও এই হানায় নিহত হয়েছেন।

ওই হানায় অন্তত আট জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। আল জাজিরা পিএমএফ-এর সূত্র উল্লেখ করে জানিয়েছে, দুটি গাড়িতে ‘হাই প্রোফাইল’ অতিথিরা ছিলেন। সেই গাড়ি দুটিতে রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। আল জাজিরার দাবি, এই ঘটনা কেবল ইরাক নয়, সামগ্রিক মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রেই বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে চলেছে। আমেরিকা ও ইরাকের মধ্যে সম্পর্কে বড়সড় ফাটল ধরে গেল এই ঘটনায়, এমন দাবি করেন আল জাজিরার ওসামা বিন জাভেদ।

মার্কিন রকেট হানায় বিধ্বস্ত গাড়ি

মৃত সোলেমানি ঠিক কে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন সোলেমানি। ইরান রেভ্যুলশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) অভিজাত বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলেমানি। পেন্টাগন জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। হামলার চেষ্টা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল আমেরিকা ও জঙ্গি সংগঠন আইসিস।

১৯৫৭ সালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরমান শহরের উপকণ্ঠে জন্মগ্রহণ করেন কাসেম সোলেমানি। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর আইআরজিসিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধে জেনারেল সোলেমানি কেরমানের ৪১ ‘সারুল্লাহ’ ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন। ওই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তিনি ইরানের পূর্ব সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তাকে আইআরজিসির কুদস (পবিত্র) বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করেন। সেই সময়ে ইরানের পূর্ব সীমান্তে তালিবান যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তার অবসান ঘটাতে সক্ষম হন তিনি। ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন কাসেম সোলেমানি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের ইরান সমর্থিত সরকারকে সহযোগিতা ও ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

আইএসবিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় বহুবার জেনারেল সোলেমানিকে হত্যার চেষ্টা করেছে জঙ্গিরা। গত অক্টোবরেও তাকে হত্যার চেষ্টা বানচাল করার কথা জানিয়েছিল ইরান। চলতি সপ্তাহে ইরানপন্থি বিক্ষোভকারীরা বাগদাদের মার্কিন দূতাবাস ঘেরাওয়ের পরে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ অভিযান ও ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন করে ইরানের কুদস ফোর্স। এসব সংগঠনকে তারা অর্থ, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। গত এপ্রিলে আইআরজিসি ও তাদের অধীনস্থ কুদস ফোর্সকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে কালো তালিকাভুক্ত করে আমেরিকা।

ইরানি সেনা রেভোলিউশন গার্ড কোরের জেনারেল কাসেম সোলেমানি

সোলেমানিকে মেরে কারা খুশি, কী হতে যাচ্ছে
ট্রাম্পের জন্য নির্বাচনে জিততে এ রকম বড় কোনো পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক টিভি চ্যানেলেই প্রাথমিকভাবে এই ঘটনাকে ইতিবাচক এক অভিযান হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের আক্রমণকে ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে চিহ্নিত করা থাকলেও টুইটার-প্রেমী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে এই ঘটনা শেষে মার্কিন পতাকার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘পোস্ট’ দিয়ে দেশের ভেতর জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা জাগিয়ে তুলতে দেরি করেননি।

শেষ বিচারে এতে বিশেষভাবে উল্লসিত হবে ইসরায়েল, আইএস ও সৌদি আরব। এই তিন শক্তির কাছে জেনারেল সোলেমানি ছিলেন সরাসরি প্রধান প্রতিপক্ষ। তবে নিশ্চিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সব দেশ এই ঘটনায় আক্রান্ত হবে।

সমরাস্ত্র ও তেলের কী হবে!
অনেক আগে থেকে ইরানকে সমরাস্ত্র উৎপাদনে বাধা দিতেই থাকে আমেরিকা। বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ইরানের রুহানী ক্ষমতায় এলে চুক্তিও হয়। কিন্তু ইরান মানেনি। তাই গত মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, ইরানকে কোনো সামরিক সাহায্য করা যাবে না। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শুরুতে ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩৮ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে। প্রতিদিন গড়ে রপ্তানি করেছে ২৩ লাখ ব্যারেল। এখানে উৎপাদন ও রপ্তানির মধ্যে বিরাট বৈষম্য লক্ষণীয়। এর মধ্যেই ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার খড়্গ, ইরান থেকে আর তেল আমদানি নয়। ওই সময় ইরান থেকে আটটি দেশ তেল আমদানি করছিল। তারা হলো চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, তুরস্ক, গ্রিস ও ইতালি। এই আটটি দেশকে অবশ্য ছয় মাসের সুযোগ দিয়ে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে তেলবিষয়ক সব লেনদেন চুকিয়ে ফেলতে হবে।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, গ্রিস, তাইওয়ান ও ইতালি এরমধ্যে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যতম বড় ক্রেতা চীন ও ভারত যথাক্রমে ৩৯ ও ৪৭ শতাংশ করে আমদানি কমিয়েছে। এতে গত বছরের মার্চ নাগাদ ইরানের অপরিশোধিত তেল রপ্তানি প্রতিদিন ১১ লাখ ব্যারেলে নেমে এসেছে। একজন মার্কিন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, তেল রপ্তানি খাতে ইরান এরমধ্যে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি রাজস্ব হারিয়েছে।গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প সদর্পে ঘোষণা করেছেন, ইরানের তেল রপ্তানি তিনি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি

জবাব পাবে আমেরিকা
তেহরানের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বড় মূল্য চোকাতে হবে তেহরানকে। শুক্রবার ভোরে বাগদাদ বিমানবন্দরের সামনেই রকেট হামলায় মৃত্যু হয়েছে ইরানি কুদস সেনাপ্রধান কাসেম সোলেমানির। এরপরেই ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ইরানের হুঁশিয়ারি, ভয়ঙ্কর জবাব পাবে আমেরিকা। সেইসঙ্গে এই হামলার পরে মধ্যপ্রাচ্যর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মার্কিন হামলায় সোলেমানির মৃত্যুর পরে পেন্টাগনের তরফে একটা বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এই বিবৃতিতে বলা হয়, “জেনারেল সোলেমানি বহুদিন ধরে ইরাকে বসবাস করা মার্কিন নাগরিক ও কূটনীতিবিদদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। গত কয়েক মাসে এই এলাকায় হওয়া সবকটি হামলার দায়ও তার।” এই হামলায় ইরাকের কাতাইব হিজবুল্লাহ নেতা আবু মেহদি আল-মুহানদিসও খতম হয়েছেন। এই মুহানদিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ইরাকে মার্কিন সেনার ওপর রকেট হামলা চালিয়েছিলেন। গত শুক্রবার ইরাক ও সিরিয়াতে থাকা কাতাইব হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর কিছু ক্যাম্পের ওপর মার্কিন বায়ুসেনার হামলার পরে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় এই গোষ্ঠীর সদস্যরা।

ইরানের বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফ জানিয়েছেন, “মধ্যপ্রাচ্যর পরিস্থিতি খারাপ বলে যে দাবি আমেরিকা করে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। এই মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে ইসলামের কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করল তারা। এই হত্যা ব্যর্থ যাবে না। এবার আমেরিকা বুঝতে পারবে, মধ্যপ্রাচ্যর পরিস্থিতি কী হতে পারে। আমেরিকাকে এই হামলার মূল্য চোকাতে হবে।”

সোলেমানির মৃত্যুতে ইরানে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। ইরানের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এই সোলেমানি। আমেরিকা ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে ইরানের জবাব দেওয়ার প্রধান মুখ ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ছক বানচাল করেছেন এই সোলেমানি। তার মৃত্যুর পরেই জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরান প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা। এই বৈঠকেই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করা হবে বলে খবর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর