ঝড় বৃষ্টি বাদল, শীত, গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে দিনের পর দিন ভয় ডরহীনভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। কার অপেক্ষায়? প্রেয়সী, প্রেমিক, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, বন্ধু কার অপেক্ষার প্রহর গুনছে সে। কিন্তু তার অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হয় না। তার নাম ডাকবাক্স।
ডাকঘর, ডাকবাক্স, ডাকপিয়ন আর চিঠি নিয়ে যুগ যুগ ধরে লেখা হয়েছে কত হাজার হাজার গান, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। কত মা-বাবা, ভাই-বোনের কান পড়ে থাকতো ডাকপিয়নের সাইকেলের বেলের দিকে। পাড়ায় মহল্লায় ডাকপিয়ন ঢুকলেই মানুষ এসে ভিড় জমাতেন। তার নামে কোনো চিঠি আছে কিনা, জানতে। দিনের পর দিন একটি চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন তারা।
চিঠি আসলে সেই চিঠিতে প্রিয়জনের আকুতি ঝড়ে পড়তো। বাবা মা কিংবা ভাই বিদেশ থেকে চিঠি পাঠালে তার নামটি লিখেছেন কি না জানতে চিঠির পাঠকের দিকে হা করে চেয়ে থাকতেন। ভুলে হয়তো তার নামটি না লেখা হলে কেঁদে বুক ভাসাতেন।
কতো প্রেমিক প্রেমিকা তার মনের কথা উজাড় করে লিখতো চিঠিতে। মুখে যা বলা না যেত তা চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করা সহজ ছিল। এমনি কত আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখের কালের সাক্ষী হয়ে এখনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ডাকবাক্সকে।
কিন্তু ডাকঘর আর ডাকবাক্সের এখন আর যৌবন নেই। ঢাকা শহরের কোনো কোনো স্থানের ডাকবাক্সের ঢালাইয়ের লোহার স্থানে স্থানে মরিচা ধরে ক্ষয়ে পড়েছে। আগের টকটকে লাল, নীল আর হলুদ রংটা মলিন হয়ে গেছে। খোদ ডাকঘরেই এরা অবহেলিত। ঢাকা তথা দেশের কোথায় এখন ডাকবাক্স তেমন আর চোখে পড়ে না।
ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত প্রধান ডাকঘরটির সামনে ডানে বামে একসময় তিন করে মোট নয়টি ডাকবাক্স দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায়। মনোযোগ দিয়ে অনেক খুঁজলে বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে পুলিশ বক্সের পাশে একটি শীর্ণকায় ডাকবাক্স চোখে পড়ে। এর একদিকে দেয়াল, একদিকে পুলিশবক্স আর বাকি দুই দিক হকাররা দখল করে আছে।
গুলশান একনম্বর গোল চত্বরে সিটি করপোরেশন মার্কেটের সামনের ফুটপাতে একটি ডাকবাক্স চেখে পড়ে।
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে লাল নীল ও হলুদ রংয়ের তিনটি ডাকবাক্স এখনও কোনো রকম টিকে আছে। লাল রংয়ের বক্সটিতে ‘বাংলাদেশ’, হলুদ রংয়ের বক্সটিতে ‘ঢাকা শহর’ ও নীল রংয়ের বক্সটিতে ‘বিদেশ’ লেখা আছে। গ্রাহককে দ্রুত সেবা দিতেই মূলত বক্সগুলোতে এ ধরনের লেখা হতো ও বিভিন্ন রং করা হতো।
হলুদ ও নীল রংয়ের বক্সটিতে একটি করে তালা দেওয়া থাকলেও লাল রংয়ের ‘বাংলাদেশ’ লেখা বক্সটিতে কোনো তালাই নেই।
বিজ্ঞান দিন দিন উৎকর্ষিত হচ্ছে আর আবেগ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াইটঅ্যাপস, টেলিগ্রাম। ডকুমেন্ট পাঠানো হচ্ছে ইমেইলে। ডিজিটাল এ যুগে ডাকঘরের আবেদন দিনদিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন যাদুঘরে গিয়ে দেখে আসতে হবে ডাকবাক্স।