গেল বছরের শেষ দিনে একটি মৃত্যুর ঘটনায় স্মৃতিকাতর হতে হয়েছিল আমাকে। আমার জন্মস্থান ও শৈশব-কৈশোরের কিশোরগঞ্জ শহরের 'কচি ভাই' সেদিন মৃত্যুবরণ করেন। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা সমাজে নিজের নামটিকে 'ব্র্যান্ডনেম'-এ পরিণত করতে পারেন, কিশোরগঞ্জের 'কচি ভাই' তেমনই একজন।
'কচি ভাই' তার সত্তর বছরস্পর্শী বয়সেও ছিলেন 'কচি' এবং সকলের 'ভাই'। কোনও কোনও নামের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বা বিশেষণের ফারাক করা যায় না। 'কচি ভাই' শহরের নাগরিকদের কাছে সেরকম চরিত্রের একজন হয়েছিলেন।
কিশোরগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলের ঈশা খাঁ সড়কের রথখোলা নিবাসী মরহুম মাহবুবুল হক সাহেবের বড় সন্তান ছিলেন মাহমুদু্ল হাসান 'কচি ভাই'। ৩১ ডিসেম্বর বিকাল ৪ টা ৫০ মিনিটে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুকালে তিনি ছোট তিন ভাই, দুই বোন, স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাদের আদিবাড়ি ছিল জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায়। কিন্তু জন্মগত কারণে তিনি ও তার ভাইবোনরা ছিলেন শহরবাসী।
সত্তর দশকের শুরুতে আমরা যখন ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে এসে বৃহত্তর জগতকে দেখছি, তখনই তিনি সবার 'কচি ভাই'। খেলাধুলা, সামাজিক বিচার-আচার ইত্যাদিতে মশগুল একজন হয়ে পাড়ায় তরুণ সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। মোটেও ভালো ছাত্র না হয়েও সাহস, স্পষ্টবাদিতা, এডভেঞ্চার-প্রিয়তার জন্য তিনি ছিলেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রে। পরে শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাস পড়ে তাকে 'নাগরিক ইন্দ্রনাথ' রূপে শনাক্ত করতে কষ্ট হয়নি।
'ইন্দ্রনাথ' যেমন, তিনিও তেমনি মোটেও আদর্শস্থানীয় ও অনুকরণীয় চরিত্র ছিলেন না। কিন্তু সেকালের ইন্দ্রনাথের মতো একধরণের 'নৈতিকতা' ছিল তার। নিজে ভালো ছাত্র নন, দিনভর আড্ডা দেন, রাতের শহরে ঘুরেন, কিন্তু পাড়ার জুনিয়ররা এসব করলে বরদাস্ত করতেন না। অন্য পাড়ার কেউ মারলে জুনিয়রদের মারপিট করতে দিতেন না। নিজে গিয়ে বা ডেকে এনে ধমকে দিয়ে বিচার করে দিতেন। কেউ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকলে হুঙ্কার দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন।
স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটটি তখন ছিল অন্য রকম। উশৃংখলতার পাশাপাশি নৈতিকতার একটি বোধ ক্ষীণকায় হলেও বিরাজমান ছিল। বখে যাওয়া বা ডানপিটে তরুণরা তখনও ছিলেন। কিন্তু তারা অন্যদেরকে দলে ভিড়িয়ে নিতেন না। নিজেদের মতো আলাদা থাকতেন। নজর রাখতেন সবার প্রতি। ইজ টিজিং বা আপত্তিকর কিছু নিজেরা করতেন না, অন্য কাউকে করতে দিতেন না। সবাই তাদের ভয়ের চোখে দেখতেন। নিজেদের শত দোষ থাকলেও তারা ছিলেন সমাজের 'নৈতিক পুলিশ'-এর মতো।
এক ধরনের গুণ্ডামি তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু সেটা নারী অপহরণ, জমি দখল ইত্যাদিতে কলুষিত ছিলনা। সমাজের সিনিয়রদের দেখলে তারা ঠিকই সম্মান ও সমীহ করতেন। যেমন চাইতেন, জুনিয়ররা পড়াশোনা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলুক।
সে সময় শহরে পাড়ায় পাড়ায় মারপিট হতো। তারা সেসবে নেতৃত্ব দিয়ে এলাকার সম্মান বাড়াতেন। আমরা বাড়ির জানলা দিয়ে সেসব দেখতে পেলেও তাতে অংশগ্রহণের অধিকার পেতাম না। সে কাজ করার জন্য 'কচি ভাই'দের আলাদা লোকবল ছিল। আমরা রথখোলার মাঠে ক্রিকেট ও ভলিবল খেলার চেয়ে বেশি সুযোগ পেতাম না।
মাস্তানি গোছের কোনও শিরোনাম না পেলেও পুলিশের খাতায় 'কচি ভাই'র নাম ছিল। একবার পুলিশ তাকে ধরতে এসে গুলি পর্যন্ত করেছিল। আমাদের চোখের সামনে রথখোলার বিরাজমোহন বাবুর বিরাট পুকুরে ডুব সাঁতার দিয়ে তিনি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেলেন। তারপর আত্মীয়-স্বজনের চাপ ও নিজের উদ্যোগে চলে গেলেন ইংল্যান্ডে।
সে আমলে বিদেশে পাড়ি দেওয়া কঠিন কাজ ছিলনা। শহরের অনেকেই জার্মানি, আমেরিকা, ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যান্বেষে নয়, বিরূপ পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচতে বিদেশযাত্রা ছিল সে আমলের সহজ পথ।
অনেকে বিদেশে স্থায়ী হলেও 'কচি ভাই' বছর দশেক পর দেশে ফিরে আসেন। তারপর সেই কিশোরগঞ্জ শহর, নরসুন্দা তীর, রথখোলার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে তার জীবন। বিশেষ কোনও ব্যবসা বা রাজনীতি নয়, সামাজিক নানা বিষয়ে মশগুল হয়ে তিনি জীবন কাটাতে থাকেন তার প্রিয়তম শহরে।
বছর খানেক আগে তার সঙ্গে শেষ দেখা পুরান থানা এলাকায়। কিশোরগঞ্জ শহরে 'কচি ভাই'র মতো আরেক চরিত্র খাইরুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকার্ত মানুষের মধ্যে তার সঙ্গে কথা হয়। কিছুদিন আগে তার ভাই, নিউইয়র্ক প্রবাসী মাহফুজুল হাসান টুপনের সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়। তিনি আমেরিকার কিশোরগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তাদের সংকলন 'হাওর'-এর জন্য আমার একটি লেখা চান তিনি। তখনও শৈশব-কৈশোরের বহু কথা চলে আসে আলাপে আলাপে।
'কচি ভাই'র মৃত্যুতে প্রলম্বিত অতীতের অনেক স্মৃতিময় ঘটনা মনে পড়তে থাকে। টের পাই, আমাদের দেখা অনেক বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আজকের প্রজন্মের রগচটা, মারমুখী তরুণ-যুবকদের সঙ্গে তাদের গুণগত পার্থক্য বুঝতেও অসুবিধা হয় না।
কোনও সমাজের কাঠামো, নাগরিক বিন্যাস, শক্তি ও ক্ষমতার ব্যবস্থাপনা, মূল্যবোধের পরিমাপ সে সমাজের মানুষগুলোকে সামনে রেখেই করতে হয়। সমাজতাত্ত্বিক বিবেচনায় মফস্বলের গতানুগতিক, শ্লথ, গড়পড়তা জীবনে আর দশটা একই মাপের সাধারণ মানুষের বাইরে বিশেষভাবে কাউকে চিহ্নিত করাও দুষ্কর। কিছু প্রাচীন ধারা, গোত্রবাদ, গোষ্ঠীচর্চা ইত্যাদি আঞ্চলিক প্রপঞ্চে আকীর্ণ মফস্বলের মানুষের মধ্যে মৌলিক মেধা, বিশেষ দক্ষতা, সৃজনী শক্তি ও মননের প্রভা দেখানোর সুযোগ অতি সামান্য। কেন্দ্রীকরণ প্রবণতায় অগ্রসররা কাজ ও বিকাশের স্বার্থে ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি কসমোপলিটানে চলে যাওয়ায় মফস্বল স্থবির হয়ে পড়ে থাকে মেডিওক্রেসির আবর্তে।
তেমনই কোনও কোনও মফস্বলে কখনও কখনও একজন চিকিৎসক, অধ্যাপক, লেখক, কবি, শিল্পী, সাংবাদিককে পুরো এলাকা, এমনকি, পুরো দেশ চিনতে পারে। এমন ঘটনা মফস্বলের সাধারণের মিছিলে কালেভদ্রে ঘটে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যায় অতি সামান্য।
বিশেষ কোনও গুণবাচক কারণে না হলেও, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংশ্লিষ্টতার গভীর তাৎপর্যে একটানা কয়েক দশক শহরের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর সামনে 'কচি ভাই' নামে সামাজিক প্রভাব ও পরিচিতি বজায় রাখাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এতোটুকু কৃতিত্বও মফস্বলের আটপৌরে সমাজপ্রবাহের নাগরিক জীবনে অনেকের পক্ষে দেখানো সম্ভব হয়না। তার সকল সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও 'কচি ভাই' সেটা সম্ভব করেছেন।
যদিও তার পক্ষে সমাজের বিশেষ কোনও দিকে আলো ফেলে আলোচিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি নিজের ভালোমন্দ অভিজ্ঞতা ও বিশেষ কোনও দক্ষতা পরবর্তী-প্রজন্মে ইতিবাচকভাবে প্রবাহিত করার দক্ষতার সঙ্গেও হয়তো পরিচিত ছিলেন না । মফস্বলের নাগরিক-সংস্কৃতি ও সমাজ-কাঠামোতে এক ধরনের গা-ছাড়া জীবন-যাপনের ধারায় তেমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কিছু করাও যোগ্য উদ্যোক্তা ও উৎসাহী ভোক্তার অভাবের কারণে দুরূহতম। তদুপরি, তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছাড়াই সকলের 'কচি ভাই' হয়ে আলোচনায়-সমালোচনায় সুদীর্ঘকাল জনমানসে বিরাজমান থাকাও মফস্বলের স্বীকৃতি-কৃপণ পরিস্থিতিতে কম কথা নয়।
জীবনভর কিশোরগঞ্জ শহরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে থেকে 'কচি ভাই' সেই সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করেছেন। জীবনের লম্বা সময় পেরিয়ে আরও অনেক দিন কিশোরগঞ্জ শহরের 'কচি ভাই' পরিচিতিতে তিনি জাগরিত থাকবেন।