'মন ভালো নেই' সমস্যা মানুষের জীবনে আসতেই পারে। জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে এই সমস্যা নানা জনের ক্ষেত্রে দেখা দেয়। সমস্যাটি সাময়িক হলে ভালো। নইলে বিপদ!
'মন ভালো নেই' স্থায়ী হয়ে ডিপ্রেশন হতে পারে। যাকে অবসাদ, হতাশা, চিত্তচাঞ্চল্য ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়। কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতি, যেমন শোক, দুর্ঘটনা, অপ্রাপ্তি ইত্যাদিতে যেমন ডিপ্রেশন হয়, তেমন শরীরবৃত্তীয় কারণেও ডিপ্রেশন হতে পারে। বয়ঃসন্ধিতে, গর্ভাবস্থায় শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের জেরে ডিপ্রেশন বা এমন ধরনের সমস্যা হয়।
শরীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রের সমস্যার জন্য মানসিক অবসাদ তৈরি হলে সাধারণত হরমোনের সমস্যাকে এজন্য দায়ী করা হয়। শরীরে নানা ধরনের হরমোন আছে। যেগুলো স্নায়ুর মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে। শরীরের কাজ চালাতে সাহায্য করে। কিছু হরমোন মেয়েদের বেশি থাকে। কিছু হরমোন পুরুষের বেশি থাকে। এসব হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে, অর্থাৎ কমবেশি-তারতম্য হলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রকট হয়।
বডি ব্যালেন্স, মুড ইমব্যালেন্স, স্মরণশক্তি, যৌনসক্ষমতা, আচরণগত নানা সমস্যা তখন মানুষকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিসও মূলত হরমোনের সমস্যা থেকে তৈরি হয়।
মানুষের শরীরের একাধিক গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড থেকে হরমোন নিঃসরণ হয়। টিউমার, ক্যান্সার ইত্যাদির কারণে গ্রন্থি আক্রান্ত হলে হরমোন প্রবাহ কম বা বেশি হয়। কখনও শরীরে ভিটামিন-ডি কম থাকলেও ক্যালসিয়াম আহরণ ও হরমোন নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে 'মন ভালো নেই' বা অবসাদ বাড়ে। নেশা ও মাদকের অত্যাসক্তিতেও হরমোন সমস্যা হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে পরিবেশগত-পরিস্থিতিগত কিংবা শরীরবৃত্তীয় সমস্যা, যে কারণেই মানসিক সমস্যা বা অবসাদ সৃষ্টি হলে দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসা করা দরকার। কারণ দীর্ঘমেয়াদে এমন সমস্যা থাকলে তা ক্রনিক ও স্থায়ী হয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিপন্ন করতে পারে। জীবনে সামনের দিকে চলার গতি হারিয়ে যেতে পারে কিংবা বিপুল সম্ভাবনাময় জীবন নেতিবাচক অন্ধকারে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।
এমন আশঙ্কা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করছেন। কারণ, অতি-প্রতিযোগিতার দ্রুতলয় জীবনে মানুষের মধ্যে চাপ বাড়ছে, তাতে মানসিক গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে। আবার অতি-যান্ত্রিক ও পরিবেশ হানিকর পরিস্থিতির কারণে খাদ্য ও পুষ্টি পেতে সমস্যা হচ্ছে। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো গ্ল্যান্ড আক্রান্ত হচ্ছে এবং এর ফলে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে শারীরিক-মানসিক সমস্যার কারণেও অবসাদ বাড়ছে মানুষের মধ্যে।
বিশ্বের ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে এখন অবসাদ স্থান পেয়েছে সামনের কাতারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই সমস্যাটি দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে বলা হচ্ছে, বর্তমান একবিংশ শতকের পৃথিবীতে দ্রুত বাড়ছে যান্ত্রিকতা ও আধুনিকতা। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের জীবনের সংগ্রাম, চাহিদা ও টার্গেট। সেইসঙ্গে বাড়ছে নানা অপ্রাপ্তি, হতাশা ও মানসিক অশান্তি। মানসিক অসুস্থতা ক্রমশ ঘিরে ধরছে বর্তমান পৃথিবীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন।
গবেষণায় উন্নত-অগ্রসর দেশের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক অঞ্চল হিসাবে। কারণ, পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাপূর্ণ দেশের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। আর বিশ্বের সবচেয়ে ডিপ্রেসড দেশ হয়েছে ভারত।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) বা হু-এর করা একটা সমীক্ষায় এমনই একটা তথ্য উঠে এসেছে। ভারতের পরেই স্থান চীন এবং আমেরিকার। স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতেই সবচেয়ে বেশি মানসিক অসুস্থতার ঘটনাগুলো ঘটে। শুধু তাই নয়, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬.৫ শতাংশ অত্যন্ত সিরিয়াস মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই বয়স কম।
বিশ্বে এত মানসিক অসুস্থতার ঘটনা যেখানে ঘটে, সেখানকার চিকিৎসার ব্যবস্থা কীরকম? হু-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে মাত্র ৫০০০ মনোবিদ এবং ২০০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। যা রোগী অনুপাতে অনেকটাই কম। যার ফলে, সঠিক চিকিৎসা থেকে অনেককেই বঞ্চিত হতে হয়।
তাছাড়াও কাউন্সিলিং, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা, হরমোন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অনেক পিছিয়ে। এবং এসব দেশেই আবার ব্যক্তিগত-পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদির অভাব প্রকট। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, হাইপারটেনশনের প্রকোপ প্রবলতর। ফলে সামনের দিনগুলোতে অবসাদ ও অন্যান্য সাইকো-ফিজিক্যাল বা শরীরবৃত্তীয়-মনোঃসমস্যা এ অঞ্চলে তীব্রভাবে আঘাত হানবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশংকা।