শীতেই শিমুল গাছে বসন্তের আবির

, ফিচার

হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-09-01 15:06:44

ক্যালেন্ডারের পাতায় বহুদিন চোখ বুলান নি, খোঁজ রাখেন না বাঙলা মাসেরও। কিন্তু পথের ধারে নিঃসঙ্গ শিমুল গাছে তাকিয়ে আপনি নিঃসংকোচে বলে ফেলতে পারেন প্রকৃতিতে এখন কোন ঋতু! কারণ বাঙালি মাত্রই জানেন- শীতের সমাপ্তিতে বসন্তের বার্তা নিয়ে প্রকৃতি রাঙিয়ে ফোটে শিমুল ফুল।

তবে শীতের বুড়ি বিদায় না নিতেই এবার রাজশাহীর মাদরাসা মাঠের পাশে দু’টি গাছে ফুটতে শুরু করেছে শিমুল ফুল। তাতেই ওড়াউড়ি করছে শালিক, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখি। কিচিরমিচির শব্দে গাছতলা দিয়ে গেলেই ভিন্ন এক অনুভূতি হবে যে কারো!

বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সকালে মাদরাসা মাঠের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটার সময় চোখে পড়ে শিমুল ফুল ফোটার দৃশ্য। ২৫ থেকে ২৮ ফুট লম্বা মাঝারি আকারের দু’টি গাছ। খুব বেশি শাখা-প্রশাখা নেই। পাতা ঝরে পুরো গাছের শাখে এখন শিমুল ফুলের কুঁড়ি। সেই কুঁড়ি ফুটে গাঢ় লাল রঙের আভা নিয়ে বেরুচ্ছে অপরূপ শিমুল ফুল।

শীতের সমাপ্তিতে বসন্তের বার্তা নিয়ে প্রকৃতি রাঙিয়ে ফোটে শিমুল ফুল

দু’একটি ফুল পুরোপুরি ফুটেছে। তবে গাছের তলায় ঝরে পড়ার সেই চিরচেনা দৃশ্যে চোখ জুড়াতে অপেক্ষা করতে হবে আরও সপ্তাহখানেক। আলাদা কোনো গন্ধ নেই, তবুও পথচারীদের বিমোহিত করে শিমুল ফুল। আর সূর্যের খরতাপে সেদিকে তাকালে চোখে ভেসে ওঠে অনন্য সৌন্দর্য্য।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিমুল গাছের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন নগরীর কাজীহাটা এলাকার আলতাফুজ্জামান খাঁন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। এগিয়ে গিয়ে তার কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমি ফায়ার সার্ভিসের মোড় হয়ে প্রতিদিন সকালে এই রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। আজই বেশি পাখির কিচিরমিচির শুনলাম। সেজন্য তাকিয়ে দেখছিলাম। এখনও সেভাবে ফুল ফোটে নি। তবুও শিমুল ফুলের দৃশ্য দেখতে দারুন লাগে।’

শিমুল ফুলের সঙ্গে পাখির মিতালি

আলতাফুজ্জামান খান বলেন, ‘শিমুল ফুল নিয়ে কিশোর বয়সের বহু মজার স্মৃতি রয়েছে। আমিও আমার ছোটবোন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এই ফুল কুড়াতাম। ফুল দিয়ে বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় বড় অক্ষরে আর্ট করার মতো করে বাবা, মা, ভাই-বোন ও নিজের নাম লিখতাম। সেখানে ভালোবাসার কথাগুলো লিখে রাখতাম। আব্বা বাড়িতে বেরুনোর সময় দেখে খুব খুশি হতো। কারটা বেশি সুন্দর হয়েছে, তা বলতেন। কাছে ডেকে আমাদের আদর করে দিতেন।’

শিমুল ফুল নিয়ে স্মৃতি রোমান্থন করতে করতে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তার কাছাকাছি বয়সী আরেক ব্যক্তি ততক্ষণে শিমুল তলায় আমাদের কথোপকথনের স্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। শুনছিলেন মনোযোগ দিয়ে। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক। বললেন- আলতাফুজ্জামানের সাথে নিয়মিত সকালে হাঁটেন তিনি। রাকিব উদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বছর তিনেক আগে অবসর নিয়েছেন।

জানতে চাইলাম তার অনুভূতিও। তিনি বলেন, ‘উনি (আলতাফুজ্জামান) যেমনটা বলছিলেন- সকালে উঠে ছোটবেলায় আমিও এই ফুল কুড়িয়েছি। সঙ্গে বরই (কুল) কুড়াতাম। নিজেদের কোনো গাছ ছিল না। পাশের বাড়ির সম্পর্কে চাচা হয়, তাদের গাছতলায় যেতাম। সেখানে মিষ্টি কুল গাছও ছিল, পাকা কুলও পড়ত। ফুল-কুল একসঙ্গে কুড়াতাম। কুড়িয়ে আনা ফুল নিয়ে দিনভর নানা রকম খেলাধুলা করতাম।’

শিমুল ফুলে ওড়াউড়ি করছে শালিক, টিয়াসহ নানা প্রজাতির পাখি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা আশরাফী নীলা বলেন, ‘পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় তুলা উৎপাদক উদ্ভিদ শিমুল। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে প্রচুর শিমুল গাছ জন্মে। শাখা-প্রশাখা কম, কিন্তু সরল ও বৃত্তাকার। বাকলে কাঁটা থাকে। কাঁটার অগ্রভাগ সরু ও তীক্ষ্ণ এবং গোড়া বেশি মোটা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুরো শীতে গাছগুলো পাতা ঝরায়। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে কুঁড়ি এবং মাঝামাঝি সময়ে পুরো গাছজুড়ে ফুল আসে। কখনও কখনও একটু আগে-পরেও ফুল ফোটে। ফুলের পাপড়ি ১০-১২ সেন্টিমিটার হয়। ফুলের পুংকেশর অনেক থাকে। স্ত্রী-কেশর পুংকেশর অপেক্ষা লম্বায় বড় হয়। মোচাকৃতির ফল ধরে এবং বৈশাখ মাসে তা ফেটে বীজ ও তুলা বের হতে থাকে।’

অধ্যাপক ফারজানা জানান, ‘বাংলাদেশে পাঁচটি প্রজাতির শিমুল গাছ বেশি দেখা যায়। রেশমি শিমুল (Bombax Buonopozense), লাল শিমুল (Bombax Ceiba), কপোক শিমুল (Bombax Costatum), পাহাড়ি শিমুল (Bombax Insigne), মোজাম্বিক শিমুল (Bombax Mossambi Cense)।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর