জোলাভাতি—একটি জীবনের বার্তা

, ফিচার

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-09-01 01:49:02

জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে হাসি, গান, আনন্দ, সবুজ, স্রোত, শিশির, ব্যাঙের ডাক, কাগজের নৌকা, মান, অভিমান আরো কত কী, কত শত শব্দ। এমনকি এই পাথর সময়ে জীবন থেকে ক্রমেই লয় হচ্ছে জীবনও। কিন্তু পৃথিবীর কোনো শূন্যতাই চির শূন্য নয়। পূর্ণ হয় তা নতুন উপাদানে, অনুষঙ্গে কিংবা অনুভূতিতে। হয়তো তাই জীবনের শূন্যতায় আজ জায়গা করে নিয়েছে হিংসা, দ্বেষ, জিঘাংসা, লাল রক্ত, নীল বেদনা। জীবনের গানের বদলে প্রতিহিংসার স্লোগান। তবুও দিন, মাস অথবা বছর শেষে অথবা হতে পারে জীবনের কোনো এক ক্ষণে আমরা খুঁজে ফেরি আমাদের সেই ফেলে আসা ‘আমি’কেই। কখনো পাই, কখনো পাই না। তবুও আমরা খুঁজে ফিরি অবিরাম। হয়তো এটাই জীবন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন

জীবনের এই বিস্তৃত চরাচরে হারিয়েছি কত কিছু। এবং প্রতিনিয়তই হারাচ্ছি অবিরাম। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন যেন এক বেদনার চৌবাচ্চা। হাসি নেই, আনন্দ নেই। যা আছে সেখানে কোনো গভীরতা। এক শ্যালো জীবন। এখান থেকে শুধু সব কিছু হারিয়ে যায় আর যায়। কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, না, সব কিছু হারিয়ে যায়নি, পাওয়ার আছে আরো অনেক কিছু। আছে গান, আনন্দ, হাসি রাশি রাশি। মনে হয় জীবন শুধু বেদনার চৌবাচ্চা নয়, বরং রসের হাড়ি।

ওই যে বললাম দিন, মাস, বছর অথবা জীবনের কোনো এক মুহূর্তে জীবন খুঁজে ফেরে তার ফেলে আসা জীবনকে। প্রতিদিনের ব্যস্ততায়, বাস্তবতায় আমরাও খুঁজেছিলাম কিছু মুহূর্ত যেখানে থাকবে হাসি, গান, আনন্দ, মনখোলা হাসি, প্রাণখোলা উল্লাস, দিলখোলা উচ্ছ্বাস। পেয়েছি কি পাইনি, তার হালখাতা আজ থাকুক। কিন্তু আমরা যে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম জীবনের জয়গানে মেতে উঠতে সেটিই কি বড় কথা নয়? হ্যাঁ, যা পেয়েছি তা শুধু আজকের নয়, আগামীরও সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে। আমাদের আটপৌরে জীবনে যোগাবে শক্তি, সাদাকালো মুহূর্তগুলোকে করবে রংধনুময়।

বার্তা পরিবারের জঙ্গলযাত্রা

সে রঙের খোঁজেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম ভোরের আলো ফোটারও বেশ আগে। খুব বেশি দূরে নয়। ঢাকার অদূরে, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। এ শহর তখনও ঘুমাচ্ছিল। যখন গাজীপুরে পৌঁছালাম সকালের নতুল আলো তখন একেবারে তেজহীন। প্রস্তুতির কমতি নেই আমাদের কোনো কিছুতেই। পার্কের পিকনিক স্পটে মুরগির গিলা কলিজা দিয়ে রান্না করা খিচুরির ঘ্রাণ সবাইকে জড়ো করলো বাবুর্চি ভাইয়ের কাছে। প্লেট নিয়ে সারিবদ্ধভাবে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম খিচুরি নিতে। একবার খেয়ে দ্বিতীয়বার খিচুড়ি নিতে লাইনে দাঁড়ায়নি এমন কেউ ছিল বলে মনে হয় না। ডেকের তলানিতে খিচুড়ির দুচারটি দানা তারই সাক্ষ্য দেয়।

ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির পরে শীতের সকালে চিরন্তন বাঙালি পিঠা পর্ব তো থাকতেই হবে। ভাপা পিঠা একটু ভাঙতে গিয়েই যে ধোঁয়া ও ঘ্রাণের উদগীরণ হলো তা পিঠাকে তার পরবর্তী গন্তব্যে পাঠিয়ে দিল। একের পর গোগ্রাসে পিঠা খাওয়া ভোগ। অতঃপর চা, কফি অন্তে বাঘ-ভালুক দর্শন।

সাফারি পার্ক সম্পর্কে আমার ধারণা খুব ভালো নেই। কক্সবাজারের দোহাজারির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের অবস্থা খুব ভালো দেখিনি। এখন কী অবস্থা জানা নেই। তবে বছর পাঁচ-ছয় আগে যা দেখেছিলাম তা চিড়িয়াখানার চেয়ে ভালো কিছু ছিল না। তবে ওই পার্কে এখনো প্রচুর গাছপালা আছে। সেখানকার গাছপালা কাটা হয়নি। গাজীপুরের পার্কটি দেখে সত্যি খুব ভালো লাগল। ঢাকার এত কাছে এরকম একটি সাফারি পার্ক আছে তা আগে বুঝতে পারিনি। বেশ সুন্দর, পরিপাটি, গোছানো, সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের দেশের সীমিত সম্পদের এই দেশে সাফারি পার্ক আশাজাগানিয়া। আসলে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে দেখভাল করলে সবকিছুই ঠিক থাকে। আমাদের সমস্যা হলো আমাদের ব্যবস্থাপনায়। সবকিছুতে সরকারের ওপর দোষ দিয়ে আমরা পার পেতে চাই। তাতে সমস্যা কমে না, বরং বাড়ে। সরকারের কাজ করে দেওয়া, রক্ষা করার বা দেখভাল করার জন্য লোকলস্করের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কিন্তু এই সেবক বা রক্ষকরা যদি রাজকর্মচারী হিসেবে নিজেদেরকে অনুমান করেন তবে সেবার অবস্থা যা হওয়ার কথা তাই হবে। আমাদের দেশের হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, শিক্ষাবোর্ড, তহসিল অফিস অথবা সরকারি গণশৌচাগার সবকিছুর অবস্থা একই রকম। এর একটাই কারণ-আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।

জঙ্গলে জোলাভাতির র‌্যাফেল ড্র

তবে, এই পার্কটিতে গিয়ে সেটিকে সুন্দর রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের এক ধরনের চেষ্টা আছে সেটি মনে হলো। এটিই আসল কথা। সীমিত সম্পদ দিয়েও অনেক কিছু করা যায়। চেষ্টাটাই আসল কথা। অনেক প্রাণীই এখানে আছে। তাদের ঠিকমতো খাবার দাবার দেওয়া জরুরি। বনের প্রাণী ধরে নিয়ে এসে তাকে না খাইয়ে সার্কাস দেখানো কোনো ভালো কথা নয়। মনে রাখতে হবে সাফারি পার্কের প্রাণ হচ্ছে জীবজন্তু। তাদের যত্নের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাকি সৌন্দর্যবর্ধন বা থ্রিডি মুভি আনুষঙ্গিক বিষয়।

এ পার্কের বিষয়ে কিছু কথা পরে এক কিস্তিতে লেখার ইচ্ছা আছে। তবে এখানে আমাদের সাফারি পার্কে জোলাভাতি নিয়ে কিছু কথা বলি। বনভোজন, পিকনিক, শিক্ষা সফর সবকিছু বাদ দিয়ে আমরা কেন জোলাভাতিতে গেলাম তার একটি দর্শন আছে। বিষয়টি শুধু একটি বাস ভাড়া করে কয়েকজন গেলাম, দেখলাম, নাচানাচি করলাম, খেলাম আর ফিরে এলাম—এর মাঝে নতুনত্ব নেই, আবিষ্কার নেই। আমরা বাংলার, বাঙালির সংবাদ সারথির কিছু কর্মী। বিশ্বাস করি যা কিছু আমাদের তাতে, চর্চাও করি সেসবের আমরা আমাদের কাজে, পেশায়, চিন্তায়, মননে চলনে। জানি, হারিয়ে গেছে অনেক কিছু এই বাংলা থেকে, বাঙালি থেকে। তবুও চর্চায় ফিরে পেতে চাই আমার আমিকে, বাঙালিকে, বাংলাকে। এবং ছড়িয়ে দিতে চাই সেসব সেখানে, যেখানে আছে বাংলা, বাঙালি। যা আমাদের আছে তাতো আছেই। যা নাই, অথবা যা হারিয়ে যাচ্ছে তাকে খুঁজে ফেরাই তো জীবনের ধর্ম। আমাদের জীবন থেকে যেমন হারিয়ে গেছে হাসি, গান, আনন্দ, সংস্কৃতি থেকেও তো হারিয়ে গেছে কতকিছু। তার হিসাব কি আমাদের আছে? কত কত গান, কত কৃষ্টি, কত আচার আজ লুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের বাঙালি জীবন থেকে। হারিয়ে গেছে কত শব্দ, কত অনুভূতি। আমরা সেসবের খোঁজ করি বাংলায় আর বাঙালির মাঝে। ভাষার মাসে আমাদের ‘জোলাভাতি’— সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দ ও সংস্কৃতি, বাঙালির হারিয়ে যাওয়া জীবনের এক গান। এ গানের সুর স্রষ্টা আমাদের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন। আমরা শুধু কোরাস গাই। তার সুরে সুরে পথ চলি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর