রডোডেনড্রন সখা-ম্যাগনোলিয়া হলো ভালোবাসার ফুল

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 17:32:05

রডোডেনড্রনের নিবিড় সান্নিধ্যে পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের উদ্দাম-পার্বত্য বাতাসে দোলে আরেক অনিন্দ্য ফুল ম্যাগনোলিয়া, যাকে ভালোবেসে স্থানীয় লোকজন বলে ‘রডোডেনড্রন-সখা’।

একটি অদ্ভুত মিথ বা পৌরাণিক কথা প্রচলিত আছে ম্যাগনোলিয়াকে ঘিরে। এই ফুল নাকি পৃথিবীর আদিমতম পুষ্প। ঐতিহাসিক কাল পেরিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে ম্যাগনোলিয়া নিভৃত পার্বত্য প্রকৃতির বুকে অপরূপ লাবণ্য ও বিভা নিয়ে প্রেমের দেবীর মতো পুষ্পিত হয়ে আছে। অবস্থান করছে রডোডেনড্রনের আশেপাশে। রডোডেনড্রনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাদা, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি রঙের ম্যাগনোলিয়ার রূপ যেন ছড়িয়ে আছে সমগ্র হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ের শরীর জুড়ে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০ ধরণের ম্যাগনোলিয়া আছে বিশ্বে। রঙের বৈচিত্র্যের সাথে জড়িয়ে আছে ফুলটির অর্থগত ব্যবহারিক নানা তাৎপয। সাদা ম্যাগনোলিয়া মানব জীবনে ‘নারী মহিমা, শুদ্ধতা আর মর্যাদার প্রতীক’, এমনটিই মনে করা হয়।

প্রাচ্য দেশেই নয়, সুদূর ইউরোপের ব্রিটেনে সেই মহারানি ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে ভালোবাসার বার্তা পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে সাদা ম্যাগনোলিয়া। প্রেমিক পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষটিকে বলতো: “তুমি একটি সুন্দর ম্যাগনোলিয়ার মতই মূল্যবান ও স্নিগ্ধ।” নারী সৌন্দয বর্ণনায় ম্যাগনোলিয়ার উপমা প্রবাদতুল্য।

শুধু ইউরোপ বা ব্রিটেন নয়, প্রাচ্যের চীন দেশেও নারীর সৌন্দর্য আর রপময়তাতে ফুটিয়ে তুলতে প্রতীক হিসেবে প্রচলিত রয়েছে শ্বেত-শুভ্র-সাদা ম্যাগনোলিয়া। আমেরিকার দক্ষিণেও আনুষ্ঠানিক উৎসবে প্রেমিকা ও স্ত্রীদের হাতে হাতে প্রেমময়তার স্মারক হয়ে শোভা পায় সাদা ম্যাগনোলিয়া।

ম্যাগনোলিয়ার রঙ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় অর্থগত তাৎপয। হলুদ ম্যাগনোলিয়া মানে সূর্য এবং পৌরুযের প্রতীক। গোলাপি ম্যাগনোলিয়াও সাদার মতো নারীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হালকা বেগুনি ম্যাগনোলিয়া মানে আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার প্রকাশ। কথিত আছে, প্রাচীন রোমানরা বেগুনি ম্যাগনোলিয়া রাখতো রাজদরবারে, রাজার প্রতি আনুগত্যের প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্যেই রাখা হতো এই ফুল।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এসে একজন ফরাসি উদ্ভিদবিদ, নাম পিয়েরে ম্যানগোল এই ফুলটি সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য দিয়েছিলেন বলে তার নামানুসারে ফুলটির নাম হয় ম্যাগনোলিয়া। রডোডেনড্রনের সঙ্গে যেমন মিশে আছে ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানি জোসেফ ডালটন হুকার-এর নাম, ম্যাগনোলিয়ার সঙ্গেও তেমনি জড়িয়ে আছে ফরাসি উদ্ভিদবিদ পিয়েরে ম্যানগোল-এর নাম।

অনেক দেশেই ম্যাগনোলিয়ার ফুলের পাপড়ি থেকে ওষুধ তৈরি করা হতো। রডোডেনড্রনের মতো বিষাক্ত নয় ম্যাগনোলিয়ায় পাপড়ি ও পল্লব। রডোডেনড্রন যেমন নেপাল, সিকিম প্রভৃতি দেশে জাতীয়ভাবে সম্মানিত, ম্যাগনোলিয়াও আদরণীয় কোরিয়ায়। উত্তর কোরিয়ার জাতীয় ফুল এই ম্যাগনোলিয়া। কোরিয়া ছাড়াও দূরপ্রাচ্যের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্দিত হয় ম্যাগনোলিয়া। বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বিস্কুট, প্রসাধনী, সাবানের প্যাকেটের গায়ে ম্যাগনোলিয়া ফুলের ছবি ব্যবহার করার প্রচলন বহু দেশেই আছে।

হিমালয়ান অঞ্চল, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার পার্বত্য জনপদের পাহাড়ে পাহাড়ে, বাড়ির সামনে, পথের ধারের খোলা জায়গায় বড়, মাঝারি এমনকি ছোট গাছেও ফুটে থাকতে দেখা যায় অজস্র ম্যাগনোলিয়া। কোনটা সাদা, কোনটা গোলাপি, কোনটা হলুদ, কোনটা বেগুনি। হয়তোবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও বিভিন্ন রঙের ম্যাগনোলিয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়েও টিকে আছে ম্যাগনোলিয়ার নান্দনিক প্রভা ও অপার সৌন্দর্য। সখা-রডোডেনড্রনের মতোই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত বর্ণবহুল ম্যাগনোলিয়া।

এ সম্পর্কিত আরও খবর