জুলিয়াস সিজার, করোনায় বিধ্বস্ত তোমার ইতালি

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 00:39:44

বীর প্রসবিনী ইতালি ছিল রোমানদের স্বদেশভূমি এবং রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান শহর, এখন করোনভাইরাসে বিধ্বস্ত এক জনপদ। সভ্যতার আদি জন্মভূমি ইতালিতে অবিরাম চলছেই মৃত্যুর মিছিল। 

বিশ্ব বিজেতা জুলিয়াস সিজারের ইতালি ছাড়িয়ে গেছে চীনের মৃত্যু সংখ্যা। বিশ্বে করোনার আঘাতে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের স্থান দখল করেছে ইতালি।

উইলিয়াম শেকসপিয়ার কালজয়ী নাটক রচনা করেছেন ইতালির সমৃদ্ধ রোমান সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটে। এসেছে জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্টোনি, ক্লিওপেট্রা, ব্রুটাসের নাম। সবই মৃত্যু, হত্যাকাণ্ড, বিশ্বাসভঙ্গের করুণ ট্র্যাজেডি। সেইসব প্রাচীন বিরহ রসের জায়গায় এখন সেখানে চলছে করোনার আঘাতে বাস্তব বিষাদকাল।

অপরাজেয় বীরের দেশে মৃত্যু ও পীড়া ঠেকাতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন ডাক্তাররা। হলি রোমান এম্পায়ারের চৌহদ্দিতে নেই প্রাণের স্পর্শ। সুসজ্জিত রোমান বাহিনীর দেশে মৃত্যুভয়ে নাগরিকগণ গৃহবন্দি।

ট্রাকের ট্রাক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গণকবরে। কেউ জানেনা, তার প্রিয় স্বজন চিরদিনের জন্য মুখ লুকিয়ে রেখেছে মাটির কোন অজানা, গভীর, নিভৃতে।

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে নেতৃত্ব দেওয়া জাতিগুলোর অন্যতম আজকের বিধ্বস্ত ইতালি মহাযুদ্ধের সময়ও লড়াই করে হেরেছে, কিন্তু বিধ্বস্ত-মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়নি। এতো অসহায়, এতে বিপন্ন কখনো হয়নি খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রোম নগরী।

বরং যুদ্ধ, আঘাত সয়ে এগিয়ে গেছে রোমানদের দেশ, যা খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সিনেট এবং সাধারণ জনগণের দ্বারা রাজতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে। এরপর রোমান প্রজাতন্ত্রটি উপদ্বীপের ইরটাস্কানস, সেল্টস এবং গ্রীকদের নিয়ে ইতালিকে একীভূত করেছিল।

পরের ইতিহাস বিশ্বজয়ের। রোমের সংগঠিত নেতৃত্ব ইটালিক জনগণের ফেডারেশনকে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং নিকট পূর্বের এপিরাস, গৌল, ব্রিটেন, হিস্পানিয়া, লুসিটানিয়া, বাল্কানস, ডাসিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, জার্মানি, মিশর, কার্থেজ, মরেটানিয়ায় কিছু অংশ জয় করে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সাথে আরো ছিল নুমিডিয়া, লিবিয়া, আনাতোলিয়া, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, আর্মেনিয়া, জুডিয়া এবং আরবের কিছু অংশও।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে সিজার অগাস্টাস প্রথম রোমান সম্রাট হয়ে পপুলারেস এবং অপটিমেটদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে প্যাক্স রোমানার সূচনা করেছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন বিশ্ব শাসন করেছে দু'টি রাজধানী থেকে। পশ্চিম অংশের কেন্দ্র ছিল রোম আর পূর্বাংশের কেন্দ্র ছিল কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুল, যা বহু বহু বছর পর পরাজিত হয়েছিল মুসলিমদের দ্বারা।    

ইতালি বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির মূল কেন্দ্রে ছিল সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই।  যেমন, নগর বিন্যাস, খনিকরণ, স্যানিটেশন এবং স্মৃতিসৌধ, রাস্তা, সেতু এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থার জনক রোমানগণ। অর্থনীতির পথ খুলেছিলেন তারা। চীন, ভারত এবং উপ-সাহারান আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যের সূচনাকারী তারা। আর্টের অভিনবত্বে মাতিয়ে ছিলেন তাবৎ পৃথিবী। গড়ে ছিলেন বিশ্ব সভ্যতার একেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, প্যানথিয়ন, আরা পাকিস, মার্বেল ভাস্কর্য, পম্পেইয়ান স্টাইলস ইত্যাদি। সাহিত্যে দিয়েছিলেন আেনিড, রূপান্তরকারী, ডি রেরুম নাটুরা, ন্যাচারালিস হিস্টোরিয়া, অ্যাব আরবে কন্ডিটাকে।

রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সম্রাট বৈদেশিক নীতি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে সফল হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন ক্লাউডিয়াস, ভেস্পাসিয়ান, ট্রাজান, মার্কাস অরেলিয়াস। তৃতীয় শতাব্দীর সামরিক নৈরাজ্য পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার দিকে পরিচালিত করে। উভয় অংশই মিলানের এডিক্ট দিয়ে খ্রিস্টানদের অত্যাচারের অবসান ঘটিয়েছিল এবং থিসালোনিকার এডিক্টের মাধ্যমে রোমের বিশপকে ধর্মীয় আধিপত্য প্রদান করেছিল।

৪৭৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে ফ্লাবিয়াস ওডোসার সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টাসকে যুদ্ধে পরাজিত করে। তারপর পশ্চিম অংশ দখলে যায় ফ্লাবিয়াস ওডোসারের ক্ষমতায় এবং সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, যা পরে মুসলিম দুনিয়ার অংশ হয়। এভাবেই সমৃদ্ধ রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

আদিম সভ্যতার পীঠস্থান ইতালির পতন হলেও মানব ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতার দিকে রূপান্তরকে চিহ্নিত করে রেনেসাঁর শুরু হয়েছিল ইতালির ফ্লোরেন্সে। শিল্প, বিজ্ঞান, অন্বেষণ এবং দর্শনের আধুনিক রূপান্তর সম্পন্ন হয়েছিল ইতালিতেই।

জুলিয়াস সিজার, করোনায় বিধ্বস্ত তোমার প্রিয় ইতালি। ভয়াবহ ট্র্যাজিডিতে ভারাক্রান্ত তোমার স্বদেশ। কিন্তু এই বিষাদ রাজনৈতিক বা সামরিক নয়। নয় শুধু ইতালির একক বেদনা। সারা পৃথিবী তোমার ইতালির পাশে আছে, জুলিয়াস সিজার। বন্ধু মার্ক এন্টোনি তোমার মিশরীয় প্রেয়সী ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে চলে গেলেও এবং স্বজন ব্রুটাস তোমার পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করলেও তুমি ও তোমার স্বদেশ একা নও, পৃথিবীর মানুষ সম্মিলিত প্রার্থনায়, সহমমিতায়, সহযোগিতায় তোমাদের পাশে আছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর