জার্মান চ্যান্সেলর গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার যে আক্রান্ত, তা ডাক্তার নিজে বা অন্য কেউই জানতেন না। ফলে রোগী ও ডাক্তার উভয়েই আক্রান্ত হলেন অতি ছোঁয়াচে, অতি অচেনা করোনাভাইরাসে।
করোনাভাইরাস অচেনা ও নতুন, তাই বলে মারাত্মকও। কেউ কিছু চেনার, বোঝার আগেই আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা ভাইরাস বহন করছেন, তারা যেমন এ সম্পর্কে জানতেন না, যাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে, তারাও তেমনি কিছুই জানতেন না।
উৎপত্তিস্থল চীনেও এমন ঘটনাই ঘটেছিল। হুবেই রাজ্যের উহান শহরের হাসপাতালে ২০১৯ সালের ১৮ থেকে ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ জন রোগী ভর্তি হন তীব্র নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে। পাঁচ দিনের মাথায় এক জন মারাও যান। কী হচ্ছে, গোড়ায় তা বুঝতেই পারেন নি কেউই।
২০২০ সালের ২ জানুয়ারির মধ্যে ল্যাবরেটরির রিপোর্ট নিশ্চিত ভাবে জানালো, হাসপাতালে ভর্তি ৪১ জন রোগী ভুগছেন নোভেল করোনাভাইরাস (সার্স-সিওভি-২) সংক্রমণে। তাদের অর্ধেকের মধ্যে আগে থেকে ছিল নানা ধরনের অসুস্থতা, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদ্রোগ, যার ফলে এই নতুন ও অচেনা ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা আন্দাজ করা কঠিন হয়।
তারপরের ঘটনা সবার জানা। প্রস্তুত হতে না হলেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। গাণিতিক হারে দ্বিগুণ, চতুর্গুণ হয়ে ছড়াতে থাকে বিশ্বময়। এবং সর্বপ্রথম আঘাতে চীন করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের নিরিখে সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।
তারপর ভয়াবহতা ও ক্ষতির দিক থেকে শীর্ষস্থান দখল করে ইতালি এবং সেটা স্পেন, যুক্তরাজ্য, ইরান ও বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায়-প্রতিটি দেশেই এক-দুজনের মৃত্যু ও বহু আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। দেশগুলোতে করোনা মহামারি আকারে বিস্তৃত হওয়ার চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।
প্রতি মুহূর্তে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাগুলো যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তা ভয়প্রদ। সার্স-সিওভি-২ যে রোগ লক্ষণগুলো তৈরি করছে তাকেই সাধারণ ভাবে বলা হচ্ছে সিওভিআইডি-১৯ বা কোভিড-১৯। বলা হচ্ছে, উহানের সামুদ্রিক জীব ও কাঁচা মাংসের পাইকারি বাজার থেকে এই রোগ ছড়িয়েছে। তবে এই ধারণা সুনিশ্চিত নয়।
অনেকের ধারণা, সংক্রমণ ছড়িয়েছে বাদুড় থেকে। বাদুড় খোলা বাজারে বিক্রি হয় না, তবে চীনদেশে অনেকে বাদুড় ধরে বিক্রি করেন বিশেষ রেস্তোরাঁগুলোতে। খুব সম্ভব বাদুড় আর মানুষের মধ্যে অন্য কোনও প্রাণী মধ্যস্থতা করেছে, মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাদুড় থেকে সংক্রমণ ছডিয়েছে সেই প্রাণীর মধ্যে। সেই প্রাণীর শরীরে ওই ভাইরাসের গঠনে দ্রুত পরিবর্তন (মিউটেশন) হয়েছে, যার ফলে তা থেকে সংক্রমণ হয়েছে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মানুষে।
করোনা বিস্তার সম্পর্কে এইসব মতামতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। অভিযোগ রয়েছে যে, এসব দেশ ল্যাবরেটোরিতে জীবাণু নিয়ে কাজ করছিল। জীবাণু-অস্ত্র তৈরি করছিল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। আর সেখান থেকেই বিপদের উৎপত্তি।
করোনাভাইরাস ছড়ানো ও উৎপত্তি সম্পর্কে নানামুখী মত ও সঠিক ধারণা পাওয়া না গেলেও একটি বিষয়ে সকলে একমত। তা হচ্ছে, অচেনা ভাইরাসটি অতি ছোঁয়াচে, মারাত্মক। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আর ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি ঘটে দুইভাবে।
প্রথমত, যারা পরস্পরের কাছাকাছি আছেন (ছয় ফুটের কম দূরত্বে), দ্বিতীয়ত, তরল ফোঁটার মাধ্যমে, যদি সংক্রমিত ব্যক্তি হাঁচেন বা কাশেন। রোগলক্ষণ যখন দেখা দেয়নি, তখনও সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে রোগ ছড়াতে পারে, তবে যাদের রোগলক্ষণ দেখা গিয়েছে, সেই অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকেই ছড়ায় বেশি।
আশ্চর্য এই যে মানবদেহের বাইরেও অনেকটা সময় এর অস্তিত্ব দেখা গিয়েছে। যেমন এয়ারোসোলের ফোঁটায় তিন ঘণ্টা, ধাতব বস্তুতে চার ঘণ্টা, কার্ডবোর্ডে ২৪ ঘণ্টা, এবং প্লাস্টিক ও স্টেনলেস স্টিলে তিন দিন অবধি বেঁচে থাকে করোনাভাইরাস। যা থেকে মনে হয়, হাওয়া থেকে বা কোনও জীবাণুদূষিত বস্তু স্পর্শ করার মাধ্যমেও মানুষের দেহে এটা আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন এই ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে আরও যা বিচার করা দরকার, তা হল কত সহজে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে, এবং অনেক বড় জনসংখ্যায় তার সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে কি না। দুর্ভাগ্যবশত, কোভিড-১৯ বেশ সহজে ছড়াচ্ছে, টিকেও থাকছে নানা দেশে। বিদেশযাত্রার জন্য বিশ্বের মানুষ এখন পরস্পরের কাছাকাছি, তাই এই ভাইরাস দেশ থেকে দেশে সহজেই ছড়াচ্ছে।
কতটা সংক্রামক কোভিড-১৯, তা-ও গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে। কাছাকাছি এলে এক ব্যক্তির থেকে দুই-তিন জনে ছড়িয়ে পড়তে পারছে ভাইরাসটি। সহজে বোঝা যায়, এর ফলে কত কম সময়ে কত বড় জনসংখ্যা ও কমিউনিটি সংক্রমিত হতে পারে। যদিও এখন করোনার মৃত্যুহার ২-৩ শতাংশ, ফ্লুতে সেখানে ০.১ শতাংশ। অর্থাৎ কোভিড-১৯ ফ্লুয়ের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি প্রাণঘাতী। তবে অচীরেই সার্স (১০ শতাংশ) বা মার্সের (৩৬ শতাংশ) জায়গা দখল করতে চলেছে কোভিড-১৯-এর মৃত্যুহার, এমনই আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।
নতুন ও অচেনা করোনা নিয়ে একটি ভুল ছিল প্রথমে। যদিও গোড়ায় মনে হয়েছিল যে প্রধানত ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। আবার এমন তথ্যও পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মৃত্যু হয়েছে পুরুষদের।
এমনটি কেন হচ্ছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈবিক এবং জীবনযাপনের শৈলী, দুই কারণেই হতে পারে এমনটি। যদিও ঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে আশা করা হচ্ছে যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সিজনাল বা মৌসুমী। এটা যে শতভাগ ঠিক, তাও বলছেন না বিশেষজ্ঞরা। যদি তা সত্যি হয়, তা হলে হয়তো রোগের প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে, যা ভবিষ্যতে সংক্রমণ কমিয়ে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাশাপাশি আরেকটি ধারণা সামনে নিয়েও কাজ হচ্ছে। তা হলো, গরমে ভাইরাস ছড়ায় কম। যদিও এখন পর্যন্ত এই ধারণার কোনও সুনিশ্চিত ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তবে, বিশ্বের দেশে দেশে যতই নতুন নতুন সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসছে, ততই বোঝা যাচ্ছে যে এই নতুন বিপদ সম্পর্কে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জানা-বোঝার পরিধি খুবই সীমিত। শুধু একটি বিষয়ই স্পষ্ট জানা যাচ্ছে যে, করোনাভাইরাস অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত তা অত্যন্ত সংক্রামক, মারাত্মক, সংবেদনশীল ও ছোঁয়াচে।
তারপরেও বিশ্বব্যাপী চিন্তার শেষ নেই। কী করে কমানো যায় কোভিড-১৯, তাই এখন সারা পৃথিবীর সামনে একমাত্র চ্যালেজ্ঞ। বিশ্বের যেসব দেশে করোনা দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে, তার অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝা যাচ্ছে যে, কেবল এর ছড়ানো রোধ করাই যথেষ্ট নয়। বরং এই ভাইরাসের মহামারীর মতো বিস্তারের বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনাই আপাতত জরুরি। যেজন্য দরকারি কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞগণ:
১. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা (বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, চোখ-নাক-মুখ স্পর্শ না করা)।
২. সংক্রমিত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রাখা (স্বেচ্ছায় আলাদা থাকা, বা নিজেই ঘরে থাকা),
৩. স্কুল-কলেজ সহ যে কোনও জমায়েত বন্ধ রাখা, যথাসম্ভব এবং যত দিন সম্ভব টেলিসংযোগের মাধ্যমে কাজ করা।
অচেনা ও নতুন এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এসবই এখন পর্যন্ত একমাত্র ও অতি-আবশ্যক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। কারণ, সারা বিশ্বে টিকা তৈরির কাজ তীব্র গতিতে চললেও সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে, তা-ও যদি গবেষণা সফল হয় ও ভাগ্য সহায় থাকে।
এমতাবস্থায়, অন্যান্য অসুখ সারাতে ব্যবহৃত ওষুধ কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে কাজ করে কি না, তা দেখা হচ্ছে। মার্স-এর বিরুদ্ধে ‘রেমডেসিভির’ ওষুধটি প্রাণীদের উপর প্রয়োগ করে ভাল ফল মিলেছে, তাই কোভিড-১৯-এর জন্যও এর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আর একটি ছোট পরীক্ষা হচ্ছে ম্যালেরিয়া-বিরোধী ওষুধ 'ক্লোরোকুইন' নিয়ে। যে রোগীরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে উঠেছেন, তাদের দেহ থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডিও রোগ নিরাময়ে কাজে আসতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা।
কিন্তু যা সব চাইতে জরুরি, তা হল এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকা যে, কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বে অতি মহামারি বা পেনডেমিক আকারে ছড়াচ্ছে এবং তা অচীরেই নিরসনের দিকে না গিয়ে আরও প্রবল হতে পারে। ফলে বিশ্ব সম্প্রাদায়, রাষ্ট্র ও সরকার, সমাজ ও মানুষ, সকলের সামনেই ভয়াবহ বিপদ আর এই বিপদ থেকে উত্তরণের দায়িত্ব বর্তেছে।
ফলে বিশ্ববাসী সকলেরই সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত কর্তব্য হলো, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং বিবেকবান ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধের নির্দেশিত পন্থা অনুযায়ী কাজ করা। যত দিন না এর কার্যকর চিকিৎসা খুঁজে পাওয়া যায়, ততদিনই কাজ করে যেতে হবে।
অচেনা, নতুন ও মারাত্মক করোনাভাইরাস-জনিত বিশ্বময় জনস্বাস্থ্যের চরমতম সঙ্কটের মোকাবেলাকে বিশ্বসম্প্রদায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলেছেন। এই মহাযুদ্ধে লড়ছে সবাই। মানুষ বনাম রোগের মহাসমরে যে যেখানে, যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। মানুষ, পৃথিবী ও মানবতাকে রক্ষা করার সঙ্কল্পে প্রতিটি মানুষকেই ঘরে-বাইরে যোদ্ধার ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। এই মহাযুদ্ধের উপরই নির্ভর করছে পৃথিবী ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ।