করোনা জীবন সম্পর্কে দিয়েছে কঠিনতম উপলব্ধি

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 15:02:18

২০২০ সালটি শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল অতি-উতপ্ত হয়। ইরানি জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়ায় ইমান শাসিত শিয়া ইরান।

মধ্যপ্রাচ্যে তার আগে থেকেই চলছিল ছায়াযুদ্ধ। ইরান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সৌদি ও মিত্রপক্ষ লড়ছিল। পুরো ভূগোল যেমন ছিল বিভাজিত, তেমনি ছিল শিয়া ও সুন্নি ইসলামের মতাদর্শিক মেরুকরণ। জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আবির্ভূত হয় মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনে। অন্যান্য পশ্চিমী পরাশক্তিগুলোও মাঠে নামে। চলমান ছায়াযুদ্ধ তখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পর্যবসিত হয় কিনা, সেটাই ছিল বিশ্ববাসীর আশঙ্কা। 

কিন্তু তখন কে জানতো যুদ্ধের চেয়েও বড় আর ভয়ঙ্কর বিপদ পৃথিবীর সামনে অপেক্ষমাণ! যে বিপদে মৃত্যুর সংখ্যা রণাঙ্গনের লাশের সংখ্যাকেও অতিক্রম করবে! পুরো পৃথিবী হবে আতঙ্কগ্রস্ত আর মানুষ ঘরবন্দী!

ঘটনার সূত্রপাত ২০১৯ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরের শেষ দিকে, যে কারণে করোনাভাইরাসের নামের সঙ্গে ১৯ লাগিয়ে করা হয়েছে কোবিদ-১৯। ঘটনাস্থল চীনের উবেই প্রদেশের উহান। এক অজানা রোগে মানুষ অসুস্থ হতে থাকে। বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, চীন নিজের সুস্থ ও স্থিতিশীল ইমেজ ধরে রাখার জন্য খবরটি বেশ কিছুদিন চেপে রাখে। বহির্বিশ্বের মানুষ ধীরে ধীরে খবরটি জানে, যখন ভাইরাস চরম মহামারির রূপ পরিগ্রহ করে। ততদিনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়িয়ে করোনা থাবা বিস্তার করে ইরানে এবং বিশ্বায়নের অতিদ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার হাত ধরে সারা পৃথিবীতে।

বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর কোনও দেশই করোনার বিপদ থেকে বাঁচতে পারেনি। মৃতের সংখ্যা হাজারে হাজারে আর আক্রান্তের সংখ্যা লাখে লাখে বাড়তে থাকে। এপিডেমিক স্তর থেকে আরও ছড়িয়ে পড়ায়  করোনাকে ঘোষণা করা হয় বৈশ্বিক মহামারি বা পেনডেমিক হিসেবে।

চীনের পর ইরান, ইতালি, স্পেন হয়ে করোনাভাইরাস ভয়াবহ থাবা বিস্তার করে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিকের ওপারে। যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রবলভাবে করোনা আক্রান্ত আর বিশ্বের সকল দেশই আশঙ্কাগ্রস্থ।

পৃথিবীতে অজানা, অচেনা এই মহামারির বিরুদ্ধে আশু প্রতিরোধ হিসেবে শুরু হয় কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউন। মানুষ সামাজিক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে শুরু করে সঙ্গরোধ। বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ এখন ঘরবন্দী।  

বলতে গেলে, মার্চ থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে সঙ্গরোধ আলতে থাকে। ক্রমেই তা আরও আঁটোসাটো হচ্ছে। কোনও কোনও দেশ এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সঙ্গরোধের কাল প্রলম্বিত করেছে। পৃথিবীর জমজমাট শহরগুলো এর ফলে হয়ে গেছে জনমানবশূন্য ভূতুরে। এক নিঃসঙ্গ পৃথিবীর চেহারা দেখা যাচ্ছে, যা সহস্র বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল, অকল্পনীয় ও ভীতিকর ঘটনা।

মানুষের জীবনে ঘরবন্দী, একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে অবসান ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ। মানুষ যে সামাজিক জীব, এই প্রগাঢ় সত্যটিই হুমকির মুখে।

ঘরবন্দী মানুষের নানা রকমের বিচিত্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের সাইবার জগৎ ভেসে যাচ্ছে বহুমুখী মতামতে। মানুষ চারপাশের জীবন ও জগতের সঙ্কুল পরিস্থিতির বাস্তবতায় প্রকাশ করছে অনেক রূঢ় সত্য।

আমার এক সহপাঠীর মন্তব্যে ভেতরটা খা খা করে উঠেছে। আশির দশকে যার সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুদীর্ঘ অধ্যয়নকাল কেটেছে আমার, সে জানিয়েছে, আজ আমার অটিস্টিক মেয়ের জন্মদিন। কাব্য আজ বাইশে পড়লো। শুভজন্মদিন মা। একজন সিঙ্গেল ফাদার হিসেবে গত ৩৪ মাস ধরে এই অটিস্টিক মা’কে নিয়ে আমি অলমোস্ট হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। গত ৩৪ মাসে সর্বোচ্চ ৩৪ দিনও আমি থিয়েটার বা স্বজনদের কাছে যেতে পারিনি। দেখতে পারিনি মঞ্চে আসা নতুন নাটক, থাকতে পারিনি আপনজনদের জন্মদিনে, বিয়েতে কিংবা জানাজায়। এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, ওদের কাছে কিংবা ঐসব অনুষ্ঠানে আমি অপরিহার্য ছিলাম না। আমি অপরিহার্য আমার মেয়ের কাছে। তাই, ওর কাছে থাকাটাই আমার জন্য সম্মানের, আনন্দের।

সে আরও জানিয়েছে, এবার আপনাকে বলছি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আপনিও এখন আর ঘরের বাইরে অপরিহার্য নন। বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজন কেউ আপনার সান্নিধ্য কামনা করছে না। কারো দরজায় টোকা দিলে কেউ এখন দরজা খুলে দেবে না। প্রকৃতিও এখন চায় না আপনাকে। তাহলে কেনো অযাচিতভাবে বাইরে যাচ্ছেন বা কারো সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন? আপনি ঘরে থাকুন। সন্তান-পরিবারসহ ঘরে থাকুন। বাস্তবতা মেনে নিন। মনে রাখবেন, প্রতিটি মুহূর্ত ভবিষ্যতের যেকোনো মুহূর্তের চেয়ে ভালো কাটাচ্ছেন। সামনে ঘোর বিপদ!

করোনা শুধু রোগের ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা, ভীতি, বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতাই দেয়নি, জীবন সম্পর্কেও আমাদেরকে দিয়েছে কঠিনতম উপলব্ধি!

এ সম্পর্কিত আরও খবর