করোনা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কথা এত পরিবর্তন হয় কেন

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-25 09:15:06

বর্তমানে সারা বিশ্বে করোনা মহামারির আকার ধারণ করেছে। ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ চেষ্টা করছেন এই ঘোড়ার মুখে লাগাম লাগানোর, একে থামানোর। কিন্তু এটা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই একজন বিজ্ঞানী আরেকজন বিজ্ঞানীর গবেষণাকে ভুল প্রমাণ করছেন বা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? বিজ্ঞান কেন তাদের একটি কথার ওপর স্থির থাকতে পারছেনা, এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবনায় আছেন।

এ ব্যাপারে কথা বলছিলেন যুক্তরাজ্যের (UK) ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে (NHS) ইমার্জেন্সি মেডিসিন ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত ডা. রাইক রিদওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের (USA) ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এট অস্টিনে পিএইচডি গবেষণারত মাইক্রোবায়োলোজিস্ট হাসান উজ জামান। বিজ্ঞানীদের কথার এমন ঘনঘন পরিবর্তন কেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মাইক্রোবায়োলোজিস্ট হাসান উজ জামান জানান, এটা আসলেই ঠিক যে করোনা নিয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকবার তাদের কথার পরিবর্তন করেছেন। তিনি বলেন, যদিও বিজ্ঞানীরা তাদের কথার এবং গবেষণার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন তবুও একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে তাদের মূল বিষয় কিন্তু এক। অর্থাৎ তারা মানুষকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে বলছেন, বারবার হাত ধোয়া, আক্রান্ত ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে থাকার কথা বলেই যাচ্ছেন। পরিবর্তন যা হচ্ছে সেটা রোগের আক্রমণ এবং আক্রান্ত করার ধরনের ব্যাপারে।

হাসান উজ জামান জানান, COVID-19 একদম নতুন একটি রোগ। সোজা বাংলায় যেটাকে “কাঁচা রোগ” বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেহেতু এ ব্যাপারে অবশ্যই বিজ্ঞানীদের কথা পরিবর্তন হবে। যেমন শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল এতে কেবল বয়স্ক ব্যক্তিদের আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। বাকিদের আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি নেই। কিন্তু পরে আরেকদল বিজ্ঞানী জানালেন, প্রমাণও মিলল, এই রোগ যুবক, বৃদ্ধ সকলের জন্যেই হুমকির। এই যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, এর কারণ হলো এই রোগের ব্যাপারে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাটা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। যার কারণে তাদের কথায় প্রায়ই এমন পরিবর্তন আসছে।

তিনি আরো জানান, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে আশি শতাংশ লোককে হসপিটালাইজড হতে হবে না, তারা বাসায় থেকেই এমনি এমনি সেরে উঠবেন। কিন্তু এই যে আশি সংখ্যা, তিনি আশঙ্কা করেন, এই সংখ্যায় পরিবর্তন হতে পারে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অবস্থার ভিত্তিতে মৃতের হার কমবেশি হয়েছে, বিভিন্ন বয়সী লোকের মৃত্যুর যে হার, সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। একইভাবে ভাইরাসটির রিপ্রোডাকশন রেইট, সংক্রমণের হারের সংখ্যায়ও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল বিষয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শ্বাসযন্ত্রের রোগ বা এজাতীয় ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় এ ব্যাপারে তারা সকলেই একমত। কেননা এগুলো আজকের গবেষণা নয়। এর আগেও সার্স কিংবা মার্সের সময় হওয়া বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এসব জেনেছেন।

শুরুতে বেশ কিছু বিজ্ঞানী বলেছিলেন গরম আসার সাথে সাথে এর প্রকোপ কমতে শুরু করবে। এখন পর্যন্ত এই কথাটিই বিজ্ঞানীদের মত পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কিছুদিন আগে আবার একদল বিজ্ঞানী এটাকে অস্বীকার করেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি আবারও কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আসলেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ভাইরাসের কার্যকারিতা হ্রাস পাবার একটা সূত্র আছে। গরমে এই ভাইরাস টিকতে পারে না, এটা ভাবার পেছনে প্রধান যে বিষয়টা কাজ করেছে তা হলো এর আকৃতি। এই ভাইরাসের চারপাশে থিকথিকে একটা কোমল আবরণ আছে। শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়—বেশি তাপমাত্রায় এই কোমল আবরণ থাকতে পারে না, নষ্ট হয়ে যায় ফলে ভাইরাসটা তখন আর কার্যকর থাকে না। এটিও অনেক আগে থেকেই গবেষণা দিয়ে প্রমাণিত। ২০১০ সালে গিনিপিগের ওপর পরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাপারটি প্রমাণিত এবং পৃথিবীর প্রায় ৭৮টি জায়গায় এমনি কোমল আবরণযুক্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে সত্যিই তাপমাত্রা বাড়লে এ জাতীয় ভাইরাসের প্রবাহ হ্রাস পায়।

তবে বিজ্ঞানে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হলো পরীক্ষাগারে যে ফলাফল পাওয়া যায়, বাস্তব ক্ষেত্রে সবসময় হুবহু তা হয় না। বরং প্রায়ই ভিন্ন হয়ে থাকে। গিনিপিগের ওপর পরিচালিত গবেষণাকে আমলে নিয়েও তাই বাস্তবে কী ঘটে তার মুখাপেক্ষী থাকতে হয় বিজ্ঞানীদের।

গ্রীষ্মে ভাইরাসের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার পেছনে অবশ্য অন্য একটি কারণ আছে। সূর্যের আলো বেশি থাকে। মানুষ প্রচুর পরিমাণ সূর্যের আলো তথা ভিটামিন ডি গ্রহণের সুযোগ পায় যেটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আর এ কারণেই শীতকালের তুলনায় গরমকালে ভাইরাসজনিত রোগ ব্যাধি খুব কম দেখা যায়। এছাড়া যারা ভিটামিন ডি-এর বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করেন তারাও এই সময়ে সুফল ভোগ করবেন।

যুক্তরাজ্যের (UK) ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে (NHS) ইমার্জেন্সি মেডিসিন ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত ডা. রাইক রিদওয়ান এই ব্যাপারে আরেকটি সম্পূরক তথ্য দেন। তিনি বলেন ১৯১৮ সালের দিকে যখন স্পেনিশ ফ্লু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ল এবং লাখ লাখ লোক মারা গেল তখনও কিন্তু তাপমাত্রা এবং সূর্যের আলোর একটা প্রভাব লক্ষ করা গেছে। তখন দেখা গেছে যাদেরকে সূর্যের আলোতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তারা তুলনামূলকভাবে সুস্থ হয়েছে বেশি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর