করোনায় অবরুদ্ধ জীবনে ‘অসহায়’ নিম্ন আয়ের মানুষ

, ফিচার

নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-27 03:13:33

কার্যত অঘোষিত লকডাউনে অচল হয়ে পড়েছে নিম্ন আয় ও ক্ষুদ্র পেশার মানুষের জীবন ও জীবিকা। অনাহার ও অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের- কথা হলে এমনটাই জানিয়েছেন নিম্ন আয়ের এসব মানুষ। অন্যদিকে কারখানায় কাজ বন্ধ থাকায় ঢাকায় আটকা পড়ে বেশ বিপাকে আছেন হাজারো পোশাক শ্রমিক। এর মধ্যেই ছুটি বাড়ানোর ঘোষণায় জীবন-জীবিকার উৎস নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

অভাবের তাড়নায় দিশেহারা সদরঘাট এলাকার মাঝি, মনি বলেন, ২৬ মার্চ থাইকা আইজ পর্যন্ত গড়ে ২০০ টাকাও ইনকাম হয় নাই। গত আট-নয়দিন কেমনে সংসার চালাইতেছি এইটা বুঝায়া কইতে পারমু না। শুনলাম ‘লকডাউন’  নাকি আরও বাড়াইছে। এমুন হইলে কেমনে কি? না খায়া মরতে হইবে। এমন অবস্থায় রাস্তায়ও তো দাড়াইতে পারমু না! শহরে মানুষ নাই ভিক্ষা দেব কেডা!

পুরান ঢাকার তারা মসজিদ এলাকায় করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় স্থানীয় উদ্যোগে একটি মহল্লা লকডাউন করে রাখা হয়েছে। মুদি দোকান আর অল্প বিস্তর কাঁচা মালের দোকান খোলা থাকলেও সেখানে গত আট দিন থেকে কোন চায়ের দোকান খোলা নেই।  অভাবের কারণে লকডাউনের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে বুধবার (১ এপ্রিল) আয়ের একমাত্র সম্বল চায়ের দোকানটি খুলেছেন আব্দুল হাদী।

কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ হাদী বলেন, জমাইনা ছব ট্যেকা শ্যাষ। না পাইরা আইজকা (বুধবার) দোকান খুলছি। ছকাল থাইকা এহুন পর্যন্ত এক ফ্লাক্স চা'ও ব্যাচতে পারি নাই বাজান। কেমনে কি করমু বুঝবার পারতাছি না।

ধানমন্ডি ও মোহাম্মাদপুর এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন আব্দুস সালাম, থাকেন রায়ের বাজার রিকশা গ্যারেজ সংলগ্ন একটি মেসে। গত ২৬ তারিখ থেকে তার আয় কমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে।

ঝুঁকির মধ্যেও দোকান খুলেছেন চা-বিক্রেতা হাদী

সালামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাত খেয়ে বাঁচলেই না করোনায় মরমু! রাস্তা-ঘাটে লোক নাই, রিকশা নিয়া বাইর হইলে যাত্রী পাই না! এমনও দিন গেছে সারা দিন রিকশা চালায়া জমার টাকা গ্যারেজে দিয়া খালি পকেটে ঘরে ফিরছি।

বেতন-ভাতা না দিয়েই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় সব গার্মেন্টস। এতে করে ঢাকায় আটকা পরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন হাজারো পোশাক শ্রমিকরা। সাভার হেমায়েতপুরের নতুন পাড়া এলাকায় মার্স ডিজাইন লিমিটেডের সাইড সিএম অপারেটর শামীম বলেন, এক দিন সন্ধ্যায় হুট করে কারখানায় গিয়ে নোটিশ দেখে জানলাম আমাদের অফিস বন্ধ, গেটে তালা দেওয়া। করোনায় কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে ভালো কথা কিন্তু আমাদের কোন বেতন-ভাতা দেয়নি। এতে আমরা তীব্র অর্থ কষ্টে ভুগছি। কারখানা বন্ধ থাকায় কোন দোকানও আমাদের বাকি দিচ্ছে না।

এছাড়া একই এলাকার হ্যাভেন ফ্যাশন লিমিটেড, আলেয়া, অর্কিড, সিসাল গ্রুপ লিমিটেডসহ, এ্যাপারেল ফোর লিমিটেডের মতো পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউই বন্ধের সময় বেতন-ভাতা পায়নি। হুট করে কারখানা বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় দোকানদাররা বাকিতে পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে চরম বিপাকে আছেন তারা।

করোনার ঝুঁকি থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগের লকডাউন করা হয়েছে পুরান ঢাকার একটি এলাকা

করোনায় অবরুদ্ধ এই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন তা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দিন এনে দিন খাওয়া বা স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য এটা কোন আরামের সময় না। এটা তাদের জন্য বিপদ। এই শ্রেণি-পেশার মানুষদের জীবন ধারণের জন্য প্রতিদিনের কাজই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সব কিছু বন্ধ থাকায় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটা দূর করতে সরকারকে আরো আন্তরিক ও স্বচ্ছ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। আগামী তিন মাসের খাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

কৃষকদের কথা যুক্ত করে এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, এমন সময়ে কৃষকরা তাদের ফসল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। কৃষকদের ফসলও সরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্রয় করতে হবে। এই তিন ব্যবস্থা গ্রহণের মতো ভালো অর্থনৈতিক অবস্থানে আছে বর্তমান সরকার। দরকার উদ্যোগ গ্রহণ ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করা।

করোনার সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রচারণা

এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ত্রাণ ও দূর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি কেমন-জানতে চাইলে দূর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এনাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, করোনার কারণে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত মাসের ২৪ তারিখ থেকেই চাল ও নগদ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট তিন দফায়  গত ২৪,২৮ ও ৩০ মার্চ এসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আবার ২ এপ্রিল একটা বরাদ্দ দেওয়া হবে। গত তিন দফায় ৩৯ হাজার ৪০০ মেট্রিকটন চাল আর ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৫৪ জন। মোট ছয় জন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মহামারি এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহবান জানিয়ে দেশের প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর