করোনাভাইরাস : দেশভেদে মৃত্যুহারে ফারাক কেন?

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-22 01:11:22

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। আক্রমণের নতুন কেন্দ্র এখন ইউরোপ; বিশেষভাবে ইতালি। ইতালিতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায় তা জার্মানির তুলনায় দশগুণ বেশি। বেড়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেও। মার্চের শেষতক ইতালিতে মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১১%-এ। একই সময়ে জার্মানিতে ছিল মাত্র ১% এবং চীনে ৪%। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কম প্রকোপ ইসরায়েলে—মাত্র ০.৩৫%।

ব্যাপারটা বিস্ময়কর। একই ভাইরাস বিভিন্ন দেশে ভিন্ন আচরণ করছে। অথচ উল্লেখযোগ্য রকমের মিউটেশনও ঘটেনি যে, দেশভেদে ভিন্ন আচরণ করবে। একই সাথে একেক সময় একেক রকম আচরণের নজিরও স্পষ্ট। এর পেছনে কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধ হয় আমাদের সনাক্ত করা ও পরীক্ষা করার ধরন।

মৃত্যুহারে ফারাক
মৃত্যুহার কিভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে—এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে দেশে দেশে। ফলে গণনায় ব্যাপক ব্যবধান জন্ম নেয়। এমনকি দুটি দেশের মৃত্যুহার সমান থাকলেও। সাধারণত দুই প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব মৃত্যুহারের সংজ্ঞায়নে। প্রথমত, পরীক্ষা করে যত লোকের কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে; তাদের মধ্য থেকে যত জন মারা গেল তার অনুপাত। একে বলা হয় ‘কেইস ফ্যাটালিটি রেট’। দ্বিতীয়ত, সর্বোপরি যাদের ইনফেকশন নিয়ে মৃত্যু হয়েছে, তার অনুপাত। সংখ্যাটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না বরং অনুমিত। একে বলা হয় ‘ইনফেকশন ফ্যাটালিটি রেট’। অন্য কথায় বললে কেইস ফ্যাটালিটি রেট বলতে বোঝায় যতগুলো মৃত্যু নিয়ে ডাক্তার নিশ্চিত এবং ‘ইনফেকশন ফ্যাটালিটি রেট’ বলতে যতজন মারা গেছে লক্ষণ নিয়ে।

বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য আমরা একটা উদাহরণ নিতে পারি। ধরা যাক, কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১০০ জন। তাদের মধ্যে দশ জনের অবস্থা এতটা নাজুক হয়েছিল যে, হাসপাতালে নিতে হয়েছে। পরীক্ষা করে সেখানে তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত ঘোষণা করা হলো। কিন্তু বাকি ৯০ জনের কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। ধরা যাক, হাসপাতালে থাকা একজন রোগী মারা গেল অর্থাৎ বাকি ৯৯ জন বেঁচে গেল। এখন এই উপাত্ত থেকে আমরা দেখতে পাই কেইস ফ্যাটালিটি রেট ১০% কিন্তু ইনফেকশন ফ্যাটালিটি রেট মাত্র ১%।

সুতরাং কোনো দেশ যদি কেবল বেশি অসুস্থদের টেস্ট করানো হয় এবং অপেক্ষাকৃত কম অসুস্থদের টেস্ট না করানো হয়—তাহলে তাদের মৃত্যুহার অনেক বেশি হবে। যেমনটা বর্তমানে যুক্তরাজ্যে হচ্ছে। টেস্ট পরিব্যাপ্ত হলে মৃত্যুহার কম যাবার উদাহরণ জার্মানি এবং দক্ষিণ কোরিয়া।

পরীক্ষার প্রভাব
‘ফ্যাটালিটি রেট’-এর একই ধরন নির্ধারণে সতর্ক থাকার পরেও ফলাফলে ব্যবধান আসতে পারে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারে অসামঞ্জস্যের অন্যতম কারণ পরিব্যাপ্ত এবং যথাযথ পরীক্ষার অভাব। বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আদতে এক দেশের সাথে অন্য দেশের তুলনা করার মতো না। এখনো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তথ্যগুলো একপাক্ষিক। সঠিক তথ্য পেতে গেলে, কেবল লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের পরীক্ষা করলেই হবে না বরং যাদের লক্ষণ নেই তাদেরকেও আনতে হবে পরীক্ষার আওতায়। তবেই দেখা সম্ভব মহামারিটি কিভাবে আমাদের গোটা জনসংখ্যাকে আঘাত করছে। একটা নির্ভরযোগ্য এবং পরিশীলিত পথ বের হবে তবেই।

শুধু সঠিক উপাত্তের খাতিরেই না, কোভিড-১৯ বহনকারীকে চিহ্নিতকরণেও গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষা করা। তার বড় প্রমাণ হতে পারে উত্তর ইতালির ভো গ্রাম। প্রথম কেইস সনাক্ত করার সময়েই গোটা গ্রামের প্রায় ৩,০০০ লোককে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছিল। দেখা গেছে ৩% অধিবাসী তখনই আক্রান্ত। অথচ কোনো প্রকার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। একই ফল দেখিয়েছে আইসল্যান্ড। ৩৬,৫০০ নাগরিকের ৩% এর বেশি জনকে আনা হয় পরীক্ষার আওতায়। লক্ষণ আছে কিংবা নেই—উভয়কেই। দেখা যায় ০.৫% নাগরিক কোভিড পজিটিভ। লক্ষণহীন নাগরিক কম থাকায় ফলাফল কম এসেছে। তাই ধরে নেওয়া হয়েছে সংক্রমণ ১% হবে, যার সাংখ্যিক মান দাঁড়ায় ৩,৬৫০ জন।

পরীক্ষা কিভাবে করা হচ্ছে—তার ওপর নির্ভর করে উপাত্ত

তাছাড়া প্রাপ্ত উপাত্তগুলো প্রায়ই ক্লিনিক্যাল, মাঠ পর্যবেক্ষণ থেকে না। সেক্ষেত্রে মান আরো ব্যাপক হতে পারত। অন্তত এন্টিবডি টেস্ট-এর আগে অব্দি। এন্টিবডি টেস্ট হলো ভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্তের দেহ কিভাবে সাড়া দিচ্ছে তা সনাক্তকরণ। এর মধ্য দিয়ে রোগী দেহের অগ্রগতি নিশ্চিত হয়ে তাকে দৈনন্দিন জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। ফলে এই টেস্টের উন্নয়ন এবং সরবরাহটা এসময় বিপ্লবাত্মক হতে পারে। ইতালির ভো-তে পরীক্ষার ব্যাপকতা বেশ ভালো ফল বয়ে এনেছে। আইসল্যান্ডের মৃত্যু সংখ্যা এখন অব্দি দুই।

কোভিড-১৯ মৃত্যু!
মৃত্যুহার হেরফের হবার পেছনে আরো কিছু কারণ সনাক্ত করতে পারি আমরা। প্রথমত, ডাক্তাররা ঠিক কীরকম মৃত্যুকে কোভিড-১৯ এর মৃত্যু বলে ঘোষণা করছেন। মনে হতে পারে বিষয়টা সহজ। যদি কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমণ অবস্থায় মারা যায় তবে তা কোভিড-১৯ এর মৃত্যু। কিন্তু পেছনে এজমার মতো কারণও থাকতে পারে যা কোভিড-১৯-কে বর্ধিত করেছে মাত্র। হতে পারে মৃত্যুটা অন্য কোনো শারিরীক পূর্ব অক্ষমতার জেরে, যার সাথে কোভিড-১৯ এর সম্পর্ক ক্ষীণ। কোন অবস্থাকে মৃত্যুর কারণ বলে ধরা হবে?

খোদ দেশের ভেতরেই সরকারি পরিসংখ্যান থেকে ভিন্ন হতে পারে যে কারো হিসাব। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। এখানে সেইসব মৃত্যু অঙ্গীভূত যাদের কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিল। কিন্তু পেছনে ক্যান্সারের মতো অন্য কারণও থাকতে পারে। অন্যদিকে দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান দিচ্ছে অন্য হিসাব। সেখানকার পরিসংখ্যানে কেবল তারাই লিপিবদ্ধ, যাদের মৃত্যুসনদে কারণ হিসাবে কোভিড-১৯ আছে। অর্থাৎ ফলাফল পৃথক হতে বাধ্য। অবশ্য এদের কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল, তা বিষয় না। তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব যৌক্তিকতা কিংবা দুর্বলতা আছে। ইতালিতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত যে কারো মৃত্যুর কারণ হিসাবে আসে কোভিড-১৯ এর নাম। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় তার উপাত্ত ভারী।

মৃত্যু কিভাবে সনাক্ত করা হচ্ছে; তা একটা বড় ইস্যু

সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তাররা আরো বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। কোভিড-১৯ মৃত্যুর তথ্য রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে জমা দেবার সময় তাদের প্রশ্ন করা হয়—রোগী কেমন অসুস্থতা নিয়ে মারা গেছেন। ডাক্তার ঠিক কী দেখে কোভিড-১৯ এর মৃত্যু সাব্যস্ত করলেন তা বের করা যায় এভাবে। হার্ট অ্যাটাক কিংবা অন্য কারণে মারা গেলে তা কোভিড-১৯ না। এভাবে উপাত্তে ফারাক হওয়াটা স্বাভাবিক। অবশ্য তা খুব বেশি না। বর্তমানে সরকারি রিপোর্টের ক্ষেত্রে আপাতত কোভিড-১৯ লক্ষণ থাকলে তা-ই ধরা হচ্ছে মৃত্যুর তালিকায়।

জটিল কারণ
কিছু রোগীর কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়নি, কিন্তু সন্দেহ থেকেও মুক্ত না। তখন পরিস্থিতি দাঁড়ায় আরো জটিল। এমন অনেক মৃত্যুই আছে, যাদের আগে থেকেই শারীরিক জটিলতা ছিল। মহামারির সময় মানুষ সাধারণত যে কোনো মৃত্যুর পেছনে একই কারণ খুঁজে পান। সঠিকভাবে দেখতে পেলে এই ভুল ধারণা থাকত না। একটা উদাহরণ হতে পারে ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লু। প্রথম দিকে মৃত্যু হার দাঁড়িয়েছিল ১০% এর উপরে। এমনকি দশ সপ্তাহ পরেও বিভিন্ন দেশে হিসাবে করে বের হয়েছে ০.১% থেকে ৫.১% অব্দি। পরবর্তীতে গবেষকরা যখন নথি ঘাঁটলেনৎ, দেখা গেল সোয়াইন ফ্লুতে প্রকৃত মৃত্যুহার অনেক কম ০.০২% এর কাছাকাছি।

গোপন মৃত্যু
একদিকে বেশি গণনার মাধ্যমে যেমন মৃত্যুহারের উপাত্ত ভারী হয়ে উঠতে পারে। সেভাবে কিছু কারণে মৃত্যুহারের পাল্লা হালকা হতে পারে। দুটিই সত্যিকার হিসাবে থেকে বিচ্যুতি। রোগের লক্ষণ দেখা যায়নি কিংবা লক্ষণ দেখা গেলেও হাসপাতালে যায়নি, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত এমন কেইস নেহায়েত অল্প না। ফলে এইসব মৃত্যু নথিভুক্ত হচ্ছে না। ইতালির লোম্বার্ডির একটি গ্রামের নাম নেমব্রো। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত মৃত্যু মাত্র ৩১ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ গত বছরের এই সময়ের মৃত্যুহারের চেয়ে এবারের মৃত্যুহার কমপক্ষে চার গুণ বেশি। সাধারণত বছরের প্রথম মাসে ৩৫ জন ব্যক্তি মারা যায় নেমব্রোতে। এবছর মারা গেছে ১৫৮ জন। এই ফলাফল পরীক্ষাহীন কোভিড-১৯ এর মৃত্যুকেই নির্দেশ করে।

হাসপাতালে পরিষেবার মান, আইসিইউ কিংবা বেডের সংখ্যাও এখানে নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। যে দেশের বেড সংখ্যা সীমিত তাদের খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোভিড-১৯ সেবা প্রদানে। ফলে সামাজিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার বেডগুলো ঠিক কতটুকু দূরে দূরে বসানো হয়েছে—সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। যদি দুই বেডের মধ্যবর্তী দূরত্ব কম থাকে তাহলে এক বেডে কোভিড-১৯ রোগী থাকলে অন্য বেডে তা দ্রুতই পরিবাহিত হবে।

বয়সের ভূমিকা
দেশে দেশে মৃত্যুহার ব্যবধানের অন্যতম কারণ বয়সের তারতম্য। পরিসংখ্যান অনুসারে ইতালিয় নাগরিকদের চারভাগের একভাগের বয়স ৬৫’র বেশি; যা চীনের তুলনায় ১১% বেশি। মার্চের মাঝামাঝি ইতালিতে কেইস ফ্যাটালিটি দাঁড়িয়েছে ৭.২%। একই সময়ে চীনের ছিল তা ২.৩%। ৭০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ইতালিতে কেইস ফ্যাটালিটি রেট ছিল ১২.৮%, যেখানে চীনে ৮%। আশির বেশি বয়সের নাগরিকদের মধ্যে দেখলে ইতালিতে ২০.২% এবং চীনে ১৪.৮%। এই অসামঞ্জস্যের কারণ এখনো অমীমাংসিত।

ইতালিতে মৃত্যুহার বেড়ে যাবার একটা কারণ তাদের গৃহীত ব্যবস্থা। রোগীর শরীরে এন্টিবায়োটিক দিয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না, নেওয়া যায় ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে। এজন্য ভাইরাল ইনফেকশনগুলো প্রায়ই অবাধ চলাচল করতে পারে। এন্টিবায়োটিকের মধ্য দিয়ে তাই ভাইরাসের না, রোগীর মৃত্যু ঘটে। যা-ই হোক, নাগরিকদের স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যাদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা আছে তারা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু হাসপাতালগুলো এখনো রোগীতে পূর্ণ এবং ডাক্তারেরা সব ব্যস্ত, আমাদের বোধ হয় আরেকটু অপেক্ষা করা দরকার।


মূলসূত্র - বিবিসি

এ সম্পর্কিত আরও খবর