ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে শেষ হচ্ছে না লকডাউন

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-26 04:20:16

বেশ কিছুদিন যাবত থমকে আছে পৃথিবী। কার্যত স্থবির হয়ে আছে জনজীবন। একঘেয়েমি, বিরক্তির সাথে যোগ হয়েছে ভয় আর হতাশা। যত দিন যাচ্ছে আতঙ্ক বাড়ছে বৈ কমছে না। মানুষ খুব দ্রতই এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। ঘরে বসে সকল সুযোগ সুবিধা পেয়েও ছটফট করছে বাইরে যাওয়ার জন্য। সবার মাঝে আজ এই প্রশ্ন উদিত হয়েছে—“আর কতদিন?”

তবে এক্ষেত্রে মহামারির ইতিহাসের দিকে তাকালে হতাশা আরো বাড়বে। দেখা গেছে কোনো কোনো মহামারি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে নিয়েছে দীর্ঘ সময়। এমনকি কোনোটির এক্ষেত্রে সময় লেগেছে প্রায় ১০০-২০০ বছর। প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কোটি মানুষের।

কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। আশার কথা হলো এই মহামারি মোকাবেলার জন্য পৃথিবীর সকল গবেষকরা একযোগে কাজ করছেন। এমনকি মোটামুটিভাবে সবাই নিজেদের কাজের সর্বশেষ অগ্রগতি উন্মুক্তও করে দিয়েছেন। তাই খুব দ্রুত গতিতেই চলছে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির উপায় বের করার কাজ।

ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে লকডাউনকেই একমাত্র উপায় বলে ভাবছে সকল দেশ। সফলতাও আসছে। বুধবার (৮ এপ্রিল) কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল উহান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে লকডাউন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছে মানুষ আবার। কিন্তু এভাবেই কি সফলতা আসবে? মুক্তি মিলবে লকডাউনের বন্দিত্ব থেকে?

এর জবাবে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সময় এখনো আসেনি। কেননা হংকং-ভিত্তিক একদল গবেষক বলছেন, নাগরিকদের প্রতিদিনের জীবন যাপনের উপর চীনের আগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ কোভিড-১৯ এর প্রথম তরঙ্গকে থামিয়ে “এ যাত্রায় প্রাণ রক্ষা” করতে পেরেছে বটে, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় তরঙ্গের বিপদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

গবষকরা অবশ্য শুরু থেকেই বলে এসেছেন লকডাউন কোনো সমাধান নয়। এটা হলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধিকে কিছুটা দমিয়ে রাখা যেন স্বাস্থ্য খাত ভেঙে না পড়ে এবং নীতি নির্ধারকগণ একটি সঠিক পরিকল্পনার গ্রহণের জন্য কিছু সময় পান। যেহেতু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। ঔষধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব দেখা দেয়—ইতালি, স্পেন থেকে খোদ আমেরিকাও এক্ষেত্রে উদাহরণ।

তাই বলে হতাশ হয়ে যাওয়ার কিছু নাই। জ্ঞান বিজ্ঞান এবং গবেষণার উন্নতির ফলে খুব সহজেই জানতে পারা গেছে কোভিড-১৯ কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে আক্রান্ত করে এবং এর জিনোম কী। যেটা ইতিহাসের আর কোনো মহামারির বেলায় এত দ্রুত জানা সম্ভব হয়নি।

জিনোম হলো জীবের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এর ওপর নির্ভর করে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। আর জিনোম সিকোয়েন্স করা মানে জীবের বৈশিষ্ট্য জানা। একটা ভাইরাস নির্মূল করতে হলে এবং এর প্রতিষেধক তৈরি করতে হলে ভাইরাসটির জিনোম এবং জিনোম সিকোয়েন্স জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে আশার কথা এই যে, এর জিনোম এবং জিনোম সিকোয়েন্স বের হতে সময় লেগেছে অন্য যে কোনো ভাইরাসের চেয়ে অনেক অনেক কম।

বলে রাখা ভালো, কোভিড-১৯ এর আগেও সম্প্রতি বেশ কিছু ভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যে ২০১৫ সালের জিকা ভাইরাস অন্যতম। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এর জিনোম সিকোয়েন্স করে প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে সময় লেগেছিল ছয় মাস।

জেনে আশান্বিত হতে পারেন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এত সময় লাগেনি। আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ার প্রায় ১৫ দিনের মধ্যেই চীনা বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের জিনের গঠন সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন এবং জানতে পারেন। এরপর সাথেসাথেই এটির জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ এবং ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু হয়।

গবেষকরা কোভিড-১৯ এর প্রতিকারক হিসেবে নির্দিষ্ট একটি ওষুধের চেয়ে, টিকা আবিষ্কারকেই এই রোগ প্রতিরোধের উত্তম উপায় বলে মনে করছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, একটি টিকার মাধ্যমে শতভাগ লোকের জন্য সম্ভব না হলেও যদি অন্তত ৫০-৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা যায় তবে একটি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকে এর সংক্রমণ থেকে বাঁচানো যায়।

পরীক্ষমূলক ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে ভ্যাকসিন

তবে কাজ শুরু করে টিকা আবিষ্কার হলেই এটি আক্রান্তের ওপর প্রয়োগ করা যায় না। এর আগে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো প্রাণী যেমন ইঁদুর, বানর ইত্যাদির ওপর তা প্রয়োগ করে দেখে নিতে হয় কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা। এ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছু স্বেচ্ছাসেবী মানুষের ওপর প্রয়োগ করে এর কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা আবারও যাচাই করা হয়। মূলত এরপরই একটি টিকা বা ভ্যাক্সিন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

আনন্দের সংবাদ এই যে, ইতোমধ্যেই তিনটি টিকা মানুষের শরীরে ব্যবহার করে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে এবং চীনের উহানে শুরু হয়েছে টিকাগুলোর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজ। এ তিন জায়গায় ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মোট ৬৫০ জন সুস্থ মানুষকে এই ট্রায়ালে যুক্ত করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আরো প্রায় ৪০টির মতো টিকা নিয়ে নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকরা। জাপানের একদল গবেষক এই ভাইরাসের ঔষধ আবিষ্কারের কাজ ও প্রায় সফলতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে দাবি করেছেন।

মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ব

গবেষকদের বলছেন, এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগতে পারে ১২ থেকে ১৮ মাস। ততদিন সতর্কতা অবলম্বন করে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করতে হবে। লক ডাউনের নিয়ম কানুন মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করতে হবে চলাফেরা। চালিয়ে যেতে হবে নিয়মিত হাত ধোয়ার কাজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর