বছরে দুইবার পুরো বাড়ির চেহারা আমূল বদলের গিয়ে ঝকঝকে-তকতকে হওয়ার স্মৃতি ৫০ বছর পরেও জ্বলজ্বল করে। একবার ঈদে, আরেকবার বৈশাখে, শুধু আমাদেরই নয়, পুরো পাড়ার ঘরবাড়িগুলোর অবয়ব বদলে যেতো । পুরনো বাড়িকে মনে হতো নতুন। বাইরের পৃথিবীকেও মনে হতো নতুনত্বর।
স্মৃতির বৈশাখ পুরনো দিনগুলোর ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সেইসব অমলিন, নতুন দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় বিগত শতাব্দীর ৭০ দশকের শৈশব আর ছোট্ট মফস্বল শহর কিশোরগঞ্জকে, যার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলতো নরসুন্দা নদী।
চৈত্রের শেষ দিনে শুরু করে বৈশাখের প্রথম প্রহরের মধ্যে সারাবাড়িতে নতুন আমেজ নিয়ে আসতেন মা। ভোল বদলে দিতেন সবকিছুর। ঘুম ভেঙে দেখি, সব নতুন, তকতকে, নতুন বছরের নতুন আলোর মতো। পহেলা বৈশাখের নতুন রোদ ঘরে এসে আমাদের ছুঁয়ে যেতো নতুন আবেগে। আমরা টের পেতাম নতুন বছরের রোমাঞ্চ ও উষ্ণতা।
নববর্ষের প্রত্যুষে দেখা পেতাম, ঝেড়ে মুছে বাড়ির চতুর্দিকের সবকিছু তখন ঝাঁ চকচকে করে রেখেছেন মা। জানলায়, দরজায় নতুন পর্দা, বিছানায় নতুন চাদর। চারদিকেই কেমন একটা নতুন নতুন গন্ধে ভেসে আমাদের শৈশবে এসে হাজির হতো পহেলা বৈশাখ।
শুরুর মতোই পুরো দিনটাও বদলে যেতো। স্কুল নেই, নিষেধ নেই, শাসন নেই, আছে শুধুই উচ্ছ্বসিত আনন্দ। পুরো শহরকেও মনে হতো অন্য রকম। সম্ভাষণ ও প্রীতির ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন নাগরিকগণ। তখন শুভেচ্ছা কার্ডের প্রচলন ছিলনা। আমরা বন্ধুদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাটাতাম পহেলা বৈশাখের সকাল বেলা।
দুপুরের আগে আগে আব্বার সঙ্গে যেতে হতো শহরের বড়বাজারে। এটি ছিল একেবারেই ধরাবাঁধা নিয়মের মতো। আব্বার কয়েকজন ভাড়াটিয়া ও রোগী বড় ব্যবসায়ী, তাদের দোকানে হালখাতা অনুষ্ঠানের সরগরম আয়োজন আর সেখানে এন্তার মিষ্টি খাওয়া চলতো বেশ অনেকক্ষণ সময় ধরে।
পহেলা বৈশাখে দুপুর বেলার খাবারে মাছ, সবজির সঙ্গে কয়েকটি মিষ্টান্ন রাখতেনই মা। এদিনে সবাই একসাথে খেতে বসার রেওয়াজ ছিল। বছরের অন্য দিন আব্বা চেম্বারে রোগীদের দেখে সুযোগ মতো খেতে আসতেন। ভাইবোনরা স্কুল, কলেজের ফাঁকে এসে খেয়ে নিতো। পহেলা বৈশাখে সবাই একসাথে খাওয়ার রীতি মানতেই হতো।
বিকেলের দিকে ছুটে যেতাম রথখোলার মাঠে, সেখানে বৈশাখী মেলা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করে সাজানো মেলা হয়, একেবারেই আদি ও অকৃত্রিম। কুমার তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্র নিয়ে হাজির। ছিল মাটির তৈরি হরেক রকমের খেলনা। কুটিরশিল্প সামগ্রীর ছড়াছড়ি। ঘুড়িওয়ালার অস্থায়ী দোকানে বাহারি ঘুড়ি, সুতা, লাটাই। মিঠাই, মণ্ডা ভেজে বিক্রি করা হচ্ছে চোখের সামনে। কখনো নাগরদোলা, সার্কাস বা পুতুলনাচ নিয়ে চলে আসতেন কোনো কোনো দল। বাঁদর নাচ, সাপের খেলা চলতো মানুষের ভিড়ের মধ্যে।
বাঁশি, সানাই বানিয়ে এনে বিক্রি করতেন গ্রাম্য কারিকর। টান দিতের সুরেলা বাঁশিতে মরমী কোনো গান। একজন চারণ কবি সুর তুলে প্রেমের আখ্যান শোনাতেন। বিকেল আর সন্ধ্যাটি জমজমাট হয়ে থাকতো মানুষের শব্দে, গানে, কোলাহলে। পহেলা বৈশাখে প্রাণবন্ত এক জীবন্ত শহর এসে দাঁড়াত আমাদের শৈশবের আঙিনায়।
রাতে কুপিবাতি, হ্যাজাক লাইট, হারিকেন বা লণ্ঠনের রহস্যময় আলো-আঁধার ঘিরে থাকতো পুরো আয়োজনকে কেন্দ্র করে। শহর আর পাশের গ্রামের মানুষের চলাচল অবিরাম চলতো অনেক রাত অবধি। মধ্যরাত পর্যন্ত মাইকে শোনা যেতো যাত্রাপালার কোনো গান বা সংলাপ। আমরা অবশ্য তার আগেই দুই হাত ভরে নানা জিনিস কিনে বাড়িতে ফিরে আসি।
পহেলা বৈশাখের দিনেই আমাদের নববর্ষের আমেজ শেষ হয়ে যেতো না। আমাদের যেতে হতো গ্রামের বাড়িতে। কুলিয়ারচরের দাদাবাড়ি আর কটিয়াদির নানাবাড়ি নিয়ে যেতে লোক আসতেন। তাদের সঙ্গে আমরা কয়েক দিনের জন্য চলে যেতাম। সেখানে মেলা ও উৎসব লেগেই থাকতো। কুঁড়িগাই নামের একটি জায়গা ছিল দাদা ও নানা বাড়ির মাঝামাঝি দূরত্বে। কয়েকশত বছরের প্রাচীন মেলা চলতো সেখানে মাজার ও পুরনো স্থাপনাকে ঘিরে। সে এক এলাহি কারবার। লোকজন, আউল-বাউল, জিনিসপত্রের বিশাল সম্ভারে ভরপুর আয়োজন।
তখন সুপার শপ ছিলনা, ইচ্ছে হলেই সব সময় হাতের কাছে কাজের জিনিসটি পাওয়া যেতো না। এইসব বড় বড় গ্রামীণ মেলা ছিল মোবাইল সুপার শপ। মা তার সারা বছরের অনেক জিনিসপত্র কিনে নিতেন মেলা থেকেই। সুন্দর নকশিকাঁথা, দা, বটি, কাঠের আসবাব, পুঁতির মালা এমন অনেক কিছুই বাড়ির জন্য কেনা হতো।
বৈশাখে গ্রামের বিকালগুলো ছিল অনেক লম্বা আর অফুরন্ত। ষাঁড়ের লড়াই, হাডুডু খেলায় ব্রহ্মপুত্রের তীরের দীর্ঘ চরভূমিতে মানুষের মেলা জমতো। আমাদের আদি বাড়িতে তখন দেখা পেতাম শহর থেকে গ্রামে আসা অনেক পরিবারের। ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রামের গল্প শোনা যেতো মা-খালাদের আসরে।
অতি শৈশবের কিশোরগঞ্জ শহরে বা গ্রামের বাড়িতে পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষকে পেয়েছি একেবারেই চিরায়ত রূপে। কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়াই প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে পালিত হতো দিনগুলো। আশির দশকে নববর্ষে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থার ব্যানারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নানা আয়োজন। শহুরে জীবনে গ্রামীণ ছোঁয়া নিয়ে প্রচলিত হয় পান্তা-ইলিশ।
স্মৃতির নিরিখে পহেলা বৈশাখকে রূপান্তরের ভেতর দিয়ে পেয়েছি। চলমানতার স্রোতে আমাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে পহেলা বৈশাখ। জীবনের পর্বে পর্বে নববর্ষের আলোয় আলোকিত হয়েছে যাপিত জীবন।
শৈশবে আদি গ্রামীণ আয়োজন থেকে শহরের সংস্কৃতিতে বিকশিত হতে দেখেছি যে বর্ষবরণকে, তা আমাদের ছোটবেলার মফস্বলের জীবনের মতোই নান্দনিকতার স্পর্শ নিয়ে জড়িয়ে আছে স্মৃতির চাদরে । তারপর ঢাকা বা চট্টগ্রামের আবহে বাংলা নববর্ষে পহেলা বৈশাখ এসেছে বহুমাত্রিক মুগ্ধতা আর জাতীয় সাংস্কৃতিক জাগরণের সমান্তরালে। বাংলার, বাঙালির শাশ্বত আত্মার অন্তর্নিহিত মর্মরধ্বনিতে আমাদের জীবনে চির মাধুর্যের সুরে ও তালে সতত বহমান বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ।