এলিয়টের 'নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাস', জীবনানন্দের আশাবাদ

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 09:57:51

ইউরোপে বসন্ত আনে এপ্রিল মাস আর বাংলায় এপ্রিলে আসে বসন্ত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণ। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি টি. এস. এলিয়ট (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮-৪ জানুয়ারি ১৯৬৫) এই এপ্রিলকে বলেছিলেন, 'নিষ্ঠুরতম মাস'। যা ছিল কবির কল্পনা, তা-ই শতবর্ষ পরে বাস্তবের কঠিনতম উপলব্ধিতে এসে হাজির হয়েছে। কারণ অসংখ্য মৃত্যু ও আক্রান্তের মাধ্যমে বৈশ্বিক মহামারিতে পর্যবসিত করোনাভাইরাস এক নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পুরো পৃথিবীকে।

১৯২২ সালে বিখ্যাত কবিতাটিতে এলিয়ট বলেন,  April is the cruelest month, breeding Lilacs out of the dead land, mixing Memory and desire, stirring Dull roots with spring rain -T.S. Eliot, “The Wasteland”

করোনা-সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতিতে এই ২০২০ সালে এলিয়টের কবিতায় বর্ণিত 'নিষ্ঠুর এপ্রিল' মাসের কথা আবার আলোচিত হচ্ছে। কবির কল্পনা ও কাব্যিক চিত্রকল্প বাস্তবের প্রেক্ষাপটে শতবর্ষ পরে দেখতে পাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। তবু বাস্তবে তেমনি হলো ২০২০ সালে এই এপ্রিল মাসে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনে উবেই প্রদেশের উহানে উদ্ভূত নতুন ও প্রাণঘাতী, ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস এপ্রিল মাসের শেষে পাঁচ মাসের বয়সসীমায় আরো সক্রিয় হয়ে  বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। তখন এলিয়টের কবিতার লাইনে উচ্চারিত ভয়ের ও নিষ্ঠুরতার এপ্রিলের কথা মনে পড়ে। আর তখনই একটি আশাবাদী উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)  কবিতা। অথচ সাধারণভাবে জীবনানন্দকে বিষণ্ণতার কবি, 'ঝরা পালক' ও 'ধূসর পৃথিবী'র বেদনামগ্ন কবি বলেই সবাই জানেন।

জীবনানন্দের ভাষায়: 'আমাদের দেখা হোক মহামারি শেষে/আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে/আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে/আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে/আমাদের দেখা হোক কান্নার ওপারে/আমাদের দেখা হোক সুখের সকালে।'

জীবনানন্দ ছিলেন এলিয়টের চেয়ে ১০ বছরের কনিষ্ঠ। কিন্তু তিনি মারা যান এলিয়টের ১০ বছর আগে। জীবনকালের হিসেবে জীবনানন্দ বেঁচে ছিলেন এলিয়টের চেয়ে কম সময়। তবু তারা ছিলেন সমসাময়িক। দেখেছেন গত শতাব্দীর বিশ শতকের মহাযুদ্ধ, মন্দা, দুর্ভিক্ষ, ডিপ্রেশন। ফলে তাদের কবিতায় সে ছবি এসেছে, যদিও তা ভিন্ন আঙিকে।

এলিয়ট ও জীবনানন্দের সময়কাল একই হলেও দুজনের পটভূমি ভিন্ন। একজন পাশ্চাত্যের জলবায়ু ও পরিবেশের সন্তান। আরেকজন প্রাচ্যের জাতক। কিন্তু এপ্রিল, উভয়ের জন্যই এবং উভয়েই জীবনেই বসন্তের সমার্থক। আমাদের প্রাচ্য দেশে পলাশ, শিমূলে বসন্ত যেভাবে আসে মার্চ ও এপ্রিলে, পাশ্চাত্যের এপ্রিলে আসে শীত শেষের সবুজ বসন্ত।

পাশ্চাত্যের শীতার্ত ভূগোলে বসন্ত এলে দিন প্রলম্বিত ও আলোকিত হয়। তাপমাত্রা বাড়ে। মনোরম রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশ জানান দেয়, শীত শেষ এবং বসন্ত এসে গিয়েছে সবুজের সমারোহে। প্রাচ্যেও ঝরাপাতার দিন শেষে কাছাকাছি সময়ে আসে বসন্ত।

কিন্তু, এবছরে, ২০২০ সালে, পৃথিবীর উভয় গোলার্ধেই বসন্ত মহামারির সম্মুখীন। প্রকৃতি জাগলেও মানুষ সামাজিক দূরত্ব পালনের জন্য সঙ্গরোধে ঘরবন্দী। মানুষ ও উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার জন্য এবার বসন্ত অবরুদ্ধ, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ।

বাংলাদেশে অভাবনীয় নৈঃশব্দের বসন্ত আমরা দেখেছি। পশ্চিমের ছবিও তেমনই। প্রকৃতিবান্ধব,  নদীর তীরের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আকাশচুম্বী অট্টালিকাময় পাশ্চাত্যের  নগরীগুলোও এই প্রাণবন্ত বসন্তে জনমানবশূন্য, ভুতুড়ে। জীবনও প্রকৃতির মতোই নিঃশব্দে বয়ে চলেছে সেখানে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাশ্চাত্যের অধিকাংশ শহর পুনর্গঠনের পর, তা এখন নানা দামি ওয়াইন আর মূল্যবান ইতিহাসে ঠাসা। কয়েক শতাব্দী পুরনো ইউনিভার্সিটি, গবেষণা, সভ্যতারচর্চার সূত্রে শহরগুলোর বাসিন্দারা পোড় খাওয়া ও ঘাত সহনীয়। কিন্তু তারাও করোনা-প্রকোপের জেরে এবং কড়া নিয়মকানুনের ফলে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতার অধিবাসী।

ঝলমলে জনপদগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং এরই মধ্যে চলছে রোগ ও মহামারির বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর লড়াই। সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান বা কাজের জায়গা এখনও পর্যন্ত খোলা রয়েছে। মার্কেটের ভেতরে লাল দাগ দিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শরীরচর্চা বা মুক্ত বাতাসের জন্য বাইরে বেরনোতে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও দুইয়ের অধিক জমায়েতে জরিমানাও রয়েছে।

আগে মানুষ, ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করলেও এখন পাহাড়ি বা প্রাকৃতিক চড়াই-উতরাই পথে সাইকেলই ভরসা। প্রত্যেক বাসই প্রায় যাত্রিহীন, এমনকি টিকিট চেক করার ব্যবস্থাও এখন বন্ধ। সবাই এই বসন্তে এক ভীতিকর, দমবন্ধ পরিবেশের কাছে সম্পূর্ণভাবে জিম্মি। মানুষের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে চরম ভীতি ও সন্ত্রস্ততায়। সারাক্ষণ এক রকম টাচ-ফোবিয়া বা সংস্পর্শ-ভীতি কাজ করেছে। দরজার হ্যান্ডেল, কফি মেশিন, চায়ের কাপ, ল্যাবের যন্ত্রপাতি হোক বা কম্পিউটার, যে কোনও কিছুই ছুঁয়ে দেখতে ভয় পাচ্ছে মানুষ।

এরচেয়ে কঠিনতম জীবন আর হতে পারেনা। এরচেয়ে নিষ্ঠুরতার এপ্রিল হতে পারেনা। এলিয়টের কল্পনার চেয়েও যা ভয়ঙ্কর। তথাপি মানুষ মব্জাগতভাবে আত্মবিশ্বাসী। নাগরিক সচেতনতা, মজবুত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও  উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে উন্নত পাশ্চাত্য দেশের মানুষ মারণ ভাইরাস প্রতিহত করতে অবিরাম প্রচেষ্টারত।

কিন্তু ঠিক উল্টো চিত্র আমাদের প্রাচ্য জনপদে। নাগরিক সচেতনতা নেই, চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অপর্যাপ্ত। অথচ সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি, নাগরিক সচেতনতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের অন্য কোনও পথই নেই আপাতত।

বিশ্বব্যাপীই করোনার বিরুদ্ধে চলমান  এই লড়াই ব্যক্তিগত নয়, আঞ্চলিক নয়, এ লড়াই সমষ্টির ও বৈশ্বিক । মানুষকে যাবতীয় মতান্তর ও বিভেদ পাশে সরিয়ে যূথবদ্ধতায় একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করার সময় এখন। এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই যত বিলম্বিত হবে, তত বিপদ বাড়বে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা করতে হবে ঘরে বসেও। করতে হবে, অভুক্তদের অন্নসংস্থান করে বা সকলকে পরিচ্ছন্নতার পাঠ দিয়ে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য একাকার এই মানুষ বনাম রোগের যুদ্ধে।

হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতাস্থল আমাদের পৃথিবী বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজও টিকে আছে। মানুষের একমাত্র বসবাসস্থল পৃথিবীকে নীরোগভাবে বাঁচিয়ে রেখে বাঁচাতে হবে মানব সম্প্রদায়কে। করোনার এই প্রতিকূল অন্ধকারময় দিনগুলো পেরিয়ে আনতে হবে জীবনের অনিন্দ্য রঙে আলোকিত জীবন। করোনা ত্রাসিত কিংবা  এলিয়টের 'নিষ্ঠুরতম এপ্রিল' মাসের আতঙ্ক পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে জীবনানন্দের আশাবাদে: আমাদের আবার দেখা হবে 'সুখের শহরে', 'সবুজ সকালে'।  

এ সম্পর্কিত আরও খবর