মধুর ক্যান্টিনের মিষ্টি

, ফিচার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 23:14:29

ঢাকা: প্রতিদিনের মত আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছি। শুক্রবার অন্যদের ছুটির দিন কিন্তু আমাকে অফিসে যেতে হবে। সময় নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। হলের সামনে থেকে রিক্সায় করে শাহবাগ; তারপর বাসে করে অফিসে এটাই ছিল পরিকল্পনা।

মহসীন হল থেকে চিরচেনা মলচত্বর, কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দিয়ে শাহবাগ যাই। আজও সে পথ ধরে রিক্সায় যাচ্ছিলাম। ছুটির দিনের ক্যাম্পাস; মোটামুটি ফাকা। দুয়েকজন মানুষ হাটাহাটি করছে। রিক্সা মধুর ক্যান্টিনের সামনে এলে দেখি সেখানেও কোন ভিড়ভাট্টা নেই। সবে মাত্র ক্যান্টিনের দরজা খুলছে একজন কর্মচারী। খানিকটা বেলা গড়ালেই ছাত্রনেতা-কর্মীদের আড্ডায় জমজমাট হয়ে উঠবে প্রাঙ্গণ।

সকালে নাস্তা করি নি। তাই মধুর ক্যান্টিনে নাস্তা করার কথা মনে হল। একটা সময় ছিল যখন প্রতিদিনের সকালের নাস্তা এখানেই করতাম। সকাল, সন্ধ্যা, রাত বন্ধুদের আড্ডাই হত মধুর ক্যান্টিনে। যা ভাবা তাই কাজ। রিক্সা বিদায় করে দিয়ে ক্যান্টিনের ভেতরে গেলাম। আমার ছাত্রজীবনের মধুর ক্যান্টিন আজো একই রকম আছে। চেয়ার টেবিলগুলা কত পরিচিত। পাউরুটির সঙ্গে ডিমের ঝাল ফ্রাই, কিংবা মিষ্টি আর বড় গ্লাসে করে লাল চা এই ছিল আমাদের নাস্তার উপকরণ। তবে মিষ্টি বেশি খাওয়া হত সে সময়। আজো তাই পাউরুটি আর মিষ্টির অর্ডার দিলাম। খানিকক্ষণ পরই মধুর ক্যান্টিনের কর্মচারী রুবেল অর্ডার নিয়ে আসল। রুবেলের কোনদিন বয়স বাড়ে না। ১০ বছর আগের রুবেল এখনো একইরকম দেখতে।

মধুর ক্যান্টিনের মিষ্টিগুলো ছোট ছোট হয়। ক্যাম্পাসের এই আকারের মিষ্টি আর কোথাও পাওয়া যায় না। সাদা রংয়ের মিষ্টি আর শিরা দিয়ে রুটি খাওয়ার মজাই অন্যরকম। দামেও খুব সস্তা। মাত্র ৫ টাকা। দাম সস্তা হওয়ার পেছনে কারণটা ঐতিহ্যগত। রাজনৈতিক নেতা তথা সবার কথা চিন্তা করেই মধু দা এই ছোট ছোট মিষ্টি তৈরি করতেন। সবসময় খেয়াল রাখতেন ছাত্রছাত্রীদের পকেটের দিকে। অসাধারণ সেই মিষ্টির স্বাদ। সিঙ্গারা, সন্দেশ, চা। ব্যস চার আনায় নাশতা কমপ্লিট। সে সময়ের অনেক খাবারই এখনও পাওয়া যায় এখানে। যার স্বাদ আগের মতোই আছে। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে খাবারের আয়োজন। সংযোজন হয়েছে অনেক নতুন খাবার। এখন প্রতি কাপ চা পাওয়া যাচ্ছে ৪-৫ টাকা। সিঙ্গারা, পাটিসাপ্টা পিঠা, মিষ্টি ও দুধের ছানা প্রতি পিছের দাম যথাক্রমে ৫, ১৫, ৫ ও ১০ টাকা।

নাস্তা নাস্তা করতে করতেই মধুর ক্যান্টিনে লোকজন আসা শুরু করেছে। সাধারণত জুম্মার নামাযের পর সাবেকরা পরিবারসহ বেড়াতে আসে। মধুর ক্যান্টিনের টেবিলে বসে নিজেদের ক্যাম্পাস স্মৃতি রোমন্থন করেন। নাস্তা শেষে রুবেলকে ডেকে বিল পরিশোধ করে আমি আবারো বেরিয়ে পড়লাম অফিসের উদ্দেশে।

মধুর ক্যান্টিনের পরিচয়

মধুসূদন দে (প্রিয় মধুদা)র জন্ম ১৯১৯ সালের ১৯ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদারদের হাতে তিনি মারা যান। পিতা আদিত্য চন্দ্র দে। মা নিরদা সুন্দরী দে। বাবার হাত ধরে মধু দা শুরু করেন এই ক্যান্টিন পরিচালনার কাজ। আদিত্য চন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন মধুসূদন দে। তখন মধুসূদনের বয়স ১৪ কি ১৫ বছর হবে। সময়টা ১৯৩৪/১৯৩৫ সাল। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া লাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডাকসুর কার্যক্রম শুরু ও ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যান্টিন পরিচালনার ভার মধুদাকে দেওয়া হয়। যদিও ক্যান্টিনটি ডাকসুর তবুও ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারীরা একে ‘মধুর স্টল’ বা মধুর ক্যান্টিন বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৬২ সালে বর্তমান কলাভবনের শিক্ষকদের লাউন্স রুমে স্থানান্তরিত করা হয় তা। এখানে চলে প্রায় পাঁচ বছর। তারপর ১৯৬৭ সালে স্থানান্তরিত হয়ে সেটি চলে আসে বর্তমান স্থানে। যা একসময় ছিল জলসাঘর। নওয়াব আমলে এ জলসাঘরে নবাবরা বাইজি নাচাতেন। সুরা পান করে আর আমোদ প্রমোদে সময় কাটাতেন এখানে। এ ঘরটির সামনে দুই পাশে দুটি বৃত্তাকার সরু একতলা ঘর আছে। এ ঘর দুটি বাইজিদের সাজঘর ও থাকার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই জলসাঘরেই ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মুসলিম লীগ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর