'ব্রিটানিকা' সাবস্ক্রাইব করায় দারুণ লাভ হচ্ছে। প্রতিদিন মেইলে প্রতিদিনের হিসেবে বিখ্যাতদের জন্ম, মৃত্যু ও বিশেষ ঘটনার ফর্দ পাঠায় তারা। এই সুবিধাজনক পাঠ-সহযোগিতার একটি অসুবিধাও আছে। গোলার্ধের তারতম্যের জন্য মেইলটি হাতে পেতে পেতে আমাদের এখানে পরদিন হয়ে যায়।
মেইল মারফত ২০ এপ্রিলের (সোমবার) তালিকা যখন পড়ার সুযোগ হলো, তখন রাত বারোটা পেরিয়ে ২১ এপ্রিল (মঙ্গলবার) শুরু হয়ে গিয়েছে। তথাপি 'ব্রিটানিকা' বলে কথা, অভ্যাসের বশে চোখ বুলিয়ে দেখি, একদা এনসাক্লোপিডিয়ার জন্য বিশ্ববিখ্যাত সংস্থার ভাষ্য ও বিবরণী। যদিও গুগলের মাধ্যমে সব তথ্য আজকাল সহজে ও অতিদ্রুত পাওয়া যায়, তথাপি বিশ্লেষণ, তথ্যবিন্যাস ও উপস্থাপনায় অ্যাকাডেমিক সৌরভ ও গাঁথুনির নিরিখে খানদানি 'ব্রিটানিকা'র সঙ্গে অন্য কারো তুলনাই চলে না।
২০ এপ্রিলে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের শীর্ষে দেখা যায় এডলফ হিটলারের নাম। ১৮৮৯ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাউনো এম ইন স্থানে জন্মে হিটলার এপ্রিল মাসেরই ৩০ তারিখ ১৯৪৫ সালে ৫৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে মারা যান। পারিবারিক দুঃসহ স্মৃতি ও প্রেক্ষাপটের অধিকারী অতি-অনুল্লেখযোগ্য তরুণটি যে পরবর্তীকালে বৃহত্তর জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদের সম্মোহনী নেতা হিসেবে শুধু নিজের দেশ বা নিজের ইউরোপ মহাদেশই নয়, তাবৎ বিশ্বের ভাগ্য/দুর্ভাগ্যের নিয়ন্ত্রায় পরিণত হবেন, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
হিটলার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। একা লড়াই শুরু করে ক্রমে ক্রমে পুরো জাতিকে তার দিকে টেনে এনেছেন। প্রবল সাহস, ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা, বাগ্মিতা ও প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণাত্মক কঠোরতার মাধ্যমে তিনিই একমাত্র সফল রাজনীতিবিদ, যিনি জার্মানির ইতিহাসে একই সঙ্গে চ্যান্সেলর ও ফুয়েরার (সর্বোচ্চ নেতা) হয়েছিলেন। সবকিছুই তিনি হাসিল করেছিলেন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল গণরায়ের মাধ্যমে।
কিন্তু ইহুদি বিদ্বেষী, যুদ্ধবাজি, আগ্রাসী অবস্থানের কারণে হিটলার গণতান্ত্রিক হয়েও নিন্দিত, সমালোচিত, যদিও তিনি জনপ্রিয়। এমনকি, জার্মানিতে এখনো হিটলারের নাৎসি মতবাদের অনুসারী রয়েছে এবং সেই নব্য নাৎসিরা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী।
হিটলারের জনপ্রিয়তা শুধু জার্মানির জনতাই নয়, তার প্রতিপক্ষ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন টের পেয়েছিল। যে কারণে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা 'কেজিবি' হিটলারের দেহাবশেষ ধূলিসাৎ করে দেয়, যাতে তার স্মৃতিসৌধ বানিয়ে তাকে স্মরণ করা না যায়।
হিটলারও নিজের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি ধরা দিতে বা পালাতে আগ্রহী ছিলেন না। কারণ, যুদ্ধে তার সহযোগী, ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনি নিজের বান্ধবীকে নিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে নির্মম ও অবমাননাকর মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন। হিটলার সে পথে যাননি। বান্ধবী ইভা ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ভূগর্ভস্থ চেম্বারে আত্মহত্যা করেন।
হিটলারের নিজের লেখা বই 'মাই ক্যাম্প' এবং আরো অসংখ্য গ্রন্থ, সিনেমা, ডকুমেন্টারির মাধ্যমে আপামর মানুষ তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবগত। সাফল্য ও ব্যর্থতা ছাপিয়ে হিটলার কুখ্যাত হয়ে আছেন ইহুদি বিদ্বেষের জন্য। কিন্তু হিটলারই একমাত্র ইহুদি বিদ্বেষী নন। ইতিহাসে ও সাহিত্যে আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা ইহুদি বিদ্বেষ লালন করেও নিন্দিত হননি।
ইউরোপের প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইংরেজি ভাষার কালজয়ী সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়ারের রচনায় সেই প্রতিফলন দেখতে
পাওয়া যায়। 'মার্চেন্ট অব ভেনিস' নাটকের সুদখোর শাইলক চরিত্রটি সেই প্রমাণ বহনকারী।
শুধু শেকসপিয়ার নন, হিটলারের জন্মের ৪০০ বছর আগে বিশ্ববিশ্রুত একজন ব্যক্তিত্ব ইহুদিদের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করেন। তিনি মার্টিন লুথার। তার 'On the Jews and Their Lies' গ্রন্থে জঘন্য ও ছাপার অযোগ্য ভাষায় ইহুদিদের গালমন্দ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইহুদিরা 'এ বেস, হোরিং, নো পিপল অব গড'। ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগকে তুলনা করা হয়েছে বেশ্যালয়ের সঙ্গে। এমনকি, ইহুদিদের স্কুল, উপাসনালয় পুড়িয়ে দেওয়ার, বাড়িঘর ধ্বংস করার, সম্পত্তি ক্রোক এবং তাদের হত্যা করার কথাও বলা হয়েছে।
জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক নিৎসের বক্তব্যের মধ্যেও নাৎসিরা নিজেদের উচ্চতর ও ইহুদি আর অন্য জাতির নিম্নতর অবস্থানের সমর্থন পেয়েছেন। আরেক বিখ্যাত দাশর্নিক হাইডেলগার সরাসরি ইহুদিদের নিন্দা করেছেন। তার রচিত গ্রন্থ ' Black Notebooks' ইহুদি বিদ্বেষের জীবন্ত দলিল।
আর্য শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিটলারের নাৎসি বা নাজিবাদ এবং প্রাচীন রোমান ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের রাজনৈতিক মতাদর্শ মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ যখন ইহুদি ও অন্য জাতিকে অবদমিত করে প্রবল বেগে বিশ্বময় এগিয়ে আসে, তখন বহু মনীষী তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হিটলার বেছে নিয়েছিলেন স্বস্তিকা চিহ্ন আর মুসোলিনি কুড়াল, যা আকৃষ্ট করেছিল অনেক কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে হিটলার ও মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোকে সরাসরি সমর্থন করলে সে সময় পাশে এসে দাঁড়ান লেখক ইভলিং ওয়া। মৌন সমর্থন জানান এলিয়ট, এইচ জি ওয়েলস, হাক্সলে এবং এজরা পাউন্ড। এলিয়টের কবিতায় ইহুদি বিদ্বেষের প্রমাণ আছে: 'My house is a decayed house/And the Jew squats on window still, the owner.' (Generation)।
কবি এজরা পাউন্ড প্রকাশ্য লেখায় ও বক্তৃতায় হিটলার-মুসোলিনির বন্দনা করেছেন। তাদের কাজের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘ ১২ বছর তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গেও ইহুদি বিদ্বেষী নাৎসিবাদ-ফ্যাসিবাদের সাযুজ্য ছিল। কবি ইয়েটস ছিলেন নাৎসিবাদ-ফ্যাসিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। নরওয়ের বিখ্যাত কবি কানুট হামসুন হিটলার-মুসোলিনির ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন।
হিটলার-মুসোলিনির বহু শতবর্ষ আগে থেকেই ইউরোপে তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ বিরাজমান ছিল। তারা যখন নাৎসিবাদী-ফ্যাসিবাদী উগ্র মতাদর্শ নিয়ে যুদ্ধ, তাণ্ডব ও ইহুদি বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু করেন, তখন সমকালের বহু নামকরা গুণীজন তাদের পাশে সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি, তাদের মৃত্যুর পরেও পশ্চিমা জগতে বজায় আছে তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ।
২০১৬ সালে প্রথম কোনো আমেরিকান লেখক হিসেবে পল বেইটি তার 'দ্য সেলআউট' উপন্যাসের জন্য 'ম্যান বুকার' পুরস্কার পান, যাতে নায়ক বর্ণবাদ ও দাসত্বপ্রথাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চান, যা শুধু ইহুদি বিদ্বেষই নয়, জাতিগত বিভেদ ও হিংসার নামান্তর। ইউরোপ ও আমেরিয়ায় নব্য বর্ণবাদীদের হুঙ্কার নতুন করে শোনা যাওয়ার মধ্যে পুরনো ইহুদি বিদ্বেষের পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট।
বহু শতাব্দী আগে থেকেই ইহুদি বিদ্বেষের বীজ ইউরোপে রোপিত এবং ইহুদি বিদ্বেষীদের দীর্ঘ তালিকা থাকার পরেও পুরো দুর্নাম একা টেনে নিতে হচ্ছে বাটারফ্লাই গোঁফের এডলফ হিটলারকে।