বিশ্বব্যাপী আধুনিক নার্সিং শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মের ২০০ বছর পূর্ণ হলো এমন একটি পরিস্থিতিতে, যখন করোনা মহামারি প্রতিরোধে নার্সরা সম্মুখ কাতারে দাঁড়িয়ে লড়ছেন। ১৮২০ সালের ১২ মে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মের স্মৃতিতে দিনটিকে বিশ্ব নার্স বা নার্সিং দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
করোনা আক্রান্ত বিশ্বে নার্সদের চলমান লড়াইকে তুলনা করা হচ্ছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঐতিহাসিক অবদানের সঙ্গে, যেজন্য তিনি বিশ্বময় পরিচিত হয়েছিলেন 'লেডি উইথ ল্যাম্প' নামে। তার জন্মের দ্বিশততম বর্ষে যুদ্ধ ও মহামারিতে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে সবাই নতুন করে সঙ্কল্প বদ্ধ হচ্ছেন। বিশেষত তার নার্সিং শিক্ষা ও পদ্ধতি, স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান এবং পারিবারিক ও জনস্বার্থ বিষয়ক ভাবনাসমূহের দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও নার্সিং ব্যবস্থার পুনর্গঠনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবন, কর্ম ও অভিজ্ঞতার নিরিখে।
বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল এবং মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেলের অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল জীবদ্দশার পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন নার্সিং নিয়ে। ব্যবহারিক নার্সিং সেবা নিয়ে তিনি যেমন দেশ-বিদেশে ছুটেছেন, তেমনি নার্সিং শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনিস্টিটিউট’র তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও তিনি পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা।
তবে, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনে সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। যখন ব্রিটেনে যুদ্ধাহতদের করুণ অবস্থার বিবরণ আসে তখন তা পুরো জাতির মতো তার চিন্তার মূল বিষয়ে পরিণত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও বিপন্নদের সহায়তা দিতে ১৮৫৪ সালের ২১ অক্টোবর তিনি এবং তার কাছেই প্রশিক্ষিত ৩৮ জন সেবিকা, তার আত্মীয় মেই স্মিথ এবং ১৫ ক্যাথোলিক নান সহ ক্রিমিয়ায় উপস্থিত হন এবং ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটিতে অবস্থান করে আর্তের সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দেখতে পায়, প্রশাসনিক অবহেলার জন্য দায়িত্বের বোঝায় পৃষ্ঠ মেডিকেল টিম যুদ্ধাহতদের ভাল যত্ন নিতে পারছিল না। ওষুধের ঘাটতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগের সংক্রমণ প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগীদের খাবার তৈরির বিশেষায়িত ব্যবস্থা ছিল না। তিনি এসব সমস্যা চিহ্নিত ও দূরীকরণের মাধ্যমে সেবার মান বৃদ্ধি ও রোগিদের কষ্টের পরিমাণ হ্রাস করতে সক্ষম হন।
বহুমুখী বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে স্বাস্থ্যসেবায় দক্ষ মানবসম্পদ তথা প্রশিক্ষিত নার্সদের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি ১৮৫৫ সালে নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৫৯ সালে তিনি ‘রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির’ প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং' ।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তার কাজকে স্বদেশ বা নিজ মহাদেশ ইউরোপে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে। একইভাবে তিনি ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। অস্ট্রেলিয়ার নার্সিং পেশার সূচনার ক্ষেত্রেও তার অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অসংখ্য পদক আর উপাধিতে ভূষিত হন। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় এমন এক মহীয়সী নারীকে, যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা' নামক বিশ্বজনীন মতাদর্শ।
তাকে নার্সিং ব্যবস্থার অগ্রণীর পাশাপাশি স্বাস্থ্য গবেষক, পারিবারিক ও জনস্বাস্থ্য পরিকল্পক, স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানবিদ এবং মেডিকেল ট্যুরিজমের অগ্রদূতের মর্যাদা দেওয়া হয়। দেশে-বিদেশে বহুজনকে নার্সিং প্রশিক্ষণ এবং নার্সিং প্রতিষ্ঠান গড়ার মতোই তার মহৎ গ্রন্থ 'নোটস অন নার্সিং' বিশ্বব্যাপী অর্জন করেছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ১৮৫৯ সালে লিখিত এ গ্রন্থে তিনি নার্সিং স্কুলে পাঠ্যসূচীর ভিত্তি রচনা করেন। তার কিছু কথা এখনো গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। যেমন, তিনি লিখেছেন, 'প্রতিদিন পরিষ্কার থাকার জ্ঞান, অথবা নার্সিং এর জ্ঞান, অন্য কথায় কিছু নিয়মাবলী, যা নিয়ে যাবে রোগমুক্ত অবস্থায় অথবা রোগ থেকে মুক্ত করবে, আরো ভাল করবে, এটা সার্বজনীন জ্ঞান, যা সবার থাকা উচিত, চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে কিছুটা আলাদা, যেটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষে সীমাবদ্ধ।'
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনের পার্কলেনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন আলোর পথের যাত্রী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। বিশ্বব্যাপী সেবিকা পেশার বিকাশের মাধ্যমে তিনি আর্ত-মানবতার কষ্টের আঁধার কেটে এনেছেন আশাবাদী আলোর জোয়ার, যে আলোর রশ্মিতে শত বিরূপতা ও প্রাণঘাতী মহামারির ভয়ঙ্কর বিপদ ঠেলে পথ চলছেন পৃথিবীর দেশে-দেশে নিবেদিতপ্রাণ শত-সহস্র সেবিকা।