তিনি এসেছিলেন ধূমকেতুর মতো। প্রেমের কবি হয়ে। বিদ্রোহের দূত হয়ে। জাতীয় গণজাগরণের প্রাণপুরুষ হয়ে। যৌবনের সুর ঝংকার তুলে।
তিনি গেয়েছিলেন সাম্যের গান। সম্প্রীতি ও মৈত্রীর জয়গান। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম (২৫ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), আমাদের জাতীয় কবি। সোমবার ১১ জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক ২৫ মে নজরুলের ১২১তম জন্মবার্ষিকী।
আজ তার জন্মদিনে একই সাথে ঈদের দিন। করোনাকালে সামাজিক দূরত্বে এইসব বিশেষ দিন উদযাপনের চেয়ে অনুভবের আঙিনায় কড়া নাড়ছে। ‘রমজানের শেষে এলো খুশির ঈদ’ বলে অবিস্মরণীয় গান রচনা করেছিলেন যে নজরুল, তেমন রমজান পেরিয়ে ঈদ এলেও সামাজিক সঙ্গরোধের কারণে আসেনি তেমন উষ্ণতা। তবু এসেছে ঈদ আর ঈদের আবহে নজরুলের স্মরণ-স্নিগ্ধ জন্মজয়ন্তী।
কঠোর সংগ্রামের মধ্যে কেটেছে নজরুলের জীবন। ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে জীবনে তিনি ছিলেন ঝঞ্ঝার মতো চঞ্চল। রুটির দোকানে চাকরি করেছেন, সৈনিক হয়ে রণাঙ্গনে গিয়েছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা।
এক জীবনে বহু পেশা আর মানুষের সাথে মিশলেও সব সময়ই নজরুল যৌবনের গান গেয়েছেন। স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা কারারুদ্ধ হয়েছেন। তবু মাথা নত করেননি উন্নত শিরের নজরুল।
নজরুল ইতিহাস ও সমাজ সচেতন সাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আত্মস্থ করেছিলেন। তিনি তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে তার সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন। মুক্তিকামী বিশ্বের জন্য নিবেদিত শ্রেষ্ঠতম বিশ্বব্যক্তিত্বে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি।
পরিণত বয়সে নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক হয়ে যান। জীবনের বাকি বছরগুলো তার কেটে যায় অপলক চেয়ে চেয়ে। নিদারুণ বেদনায় উচ্ছল কবি নিরব জীবন পাড়ি দেন।
তবু নজরুল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রূপকার হিসেবে কালজয়ী সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন। তার গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস মিলিয়ে এক বিশাল সম্ভার মোহিত করে রেখেছে বাংলা ও বাঙালিকে।
বিশেষ করে নজরুলের গান প্রেমে, বিরহে, বিদ্রোহে, মৈত্রী ও মুক্তিতে প্রাণিত করছে লক্ষ-কোটি মানুষকে। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি চিত্তে অম্লান আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন তিনি।
নজরুল ছিলেন মানবমুক্তির সারথি। শোষণ ও ধর্মান্ধতা বিরোধী। অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান যুগ-যুগান্তের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে আপামর মানুষকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তিনি শোষিত, বঞ্চিত, সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠস্বর।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব একেবারেই দীপ্তিময়। হঠাৎ এক প্রবল ঝড়ের মতো তিনি বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়ে সমস্ত অবিভক্ত বাংলাকে চমকিত ও আলোকিত করেছিলেন। সঞ্জিবনী মন্ত্রে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।’ বলেছিলেন কারার লৌহ কপাট ভেঙে, শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত হতে। জাতীয় জাগরণে প্রাণস্পন্দিত সুরে নজরুল জাগিয়ে ছিলেন সমগ্র বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে।
বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি তিনি শেষকাল কাটান স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় তিনি শায়িত। ‘মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই’ বলে যে আকুতি তিনি জানিয়েছিলেন গানে, সেটাই বাস্তবতা লাভ করে তার জীবন সায়াহ্নে।
জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও এ বছর করোনাভাইরাসের বিরূপ পরিস্থিতির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে এ উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্মিত ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’ শীর্ষক আনুমানিক ৫০ মিনিটের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচারিত হয়েছে। পবিত্র ঈদ উল ফিতরের সঙ্গরোধের আনন্দময় দিনে সবাই ঘরে বসে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে প্রিয়তম কবি নজরুলকে। বিশেষ পরিস্থিতিকে অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে নজরুলের জন্মজয়ন্তী উদযাপিত না হলেও মানুষের যাপিত জীবনের সমান্তরালে তিনি সর্বক্ষণ জাগরিত আছেন বাঙালির চৈতনের সরণীতে।