বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে ইলিশ যন্ত্রণা!

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:12:16

 

ত্রিপুরা, ভারত: ভারতে ঘুরতে যাবো শুনে ঢাকায় সবাই জিজ্ঞাসা করতেন, কলকাতা নাকি আজমীর বা কাশ্মীর ঘুরতে যাবেন? আমি সাব্রুম বলাতে চোঁখের পাতা উল্টিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, এটা কোথায়? বা ওখানে কি? আমি বলতাম, সাব্রুম শান্তির জায়গা। এটা দক্ষিণ ত্রিপুরার একটা মহকুমা, গ্রাম পঞ্চায়েত। ছোট খালের মতো নদী পেরোলে খাগড়াছড়ির রামগড়। তবে নদীর হাঁসেরা এই পাড় ওই পাড় হয়ে সাঁতার কাটলে ও বাংলা ভাষাভাষী দুই দেশের মানুষ কিন্তু চাইলেই নদী পাড় হতে পারেন না।

১৫ হাজারের বেশি মানুষ না হলে সেটা কর্পোরেশন হয় না, মহকুমা থাকে। সাব্রুম এমনই শান্ত প্রকৃতির এক বাজার। যেখানে ব্যস্ত বিকেলেও হয়তো ১০০ এর বেশি মানুষ থাকে না৷

বন্দন দা  আর যীশু দা'র সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ এর ডিসেম্বর থেকে। তখন আমি আর বর্তমানে প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক দীপু মালাকার দুজনই বাংলানিউজের করেসপন্ডেন্ট। আমি গল্প লিখি, দীপু ছবি তোলেন৷ বন্দন দা আগরতলার দৈনিক সংবাদের স্থানীয় প্রতিনিধি এবং যীশু দা তার বাল্য বন্ধু এবং এখানকার ব্যবসায়ী। এখানকার মানুষের ভাষা নোয়াখালি। যীশু দা'রা নিজেদের নোয়াখালি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রয়েছে সাব্রুমের। এখানে এবং হরিণায় যেমন শরণার্থী ক্যাম্প ছিল তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও ছিল। রামগড় হানাদার মুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুমের মানুষও নদী পার হয়ে উল্লাসে শামিল হয়েছিলেন। সাব্রুমে আসলে, কথা বলতে, হাঁটতে কখনোই মনে হবে না আপনি দেশের বাইরে আছেন। মানুষের সঙ্গে গল্প করে জানা যাবে তাদের ভাবনা।

 

ঈদের ছুটির আগে দুদিন সাব্রুম থেকে বেড়িয়ে আসার প্ল্যান৷ কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইলে, বন্দন এবং যীশু দা দুজনেই বললেন, ভালবাসা এনো। আবারো জিজ্ঞাসা করতে বন্দন দা বললেন, যদি পদ্মার ইলিশ পাও, নিয়ে এসো। তবে পদ্মার ইলিশ না পেলেও ফেনীতে রামগতিতে চাঁদপুরের ইলিশ পাওয়া যায়৷ নদী ভেদে ইলিশের স্বাদের পার্থক্যে কি তারতম্য হয় সেটা আমার বোধগম্য হয়নি কখনো। আমার কাছে মাছটা তাজা হওয়াটাই মুখ্য।

শনিবার সকালে ফেনী শহরের হকার্স মার্কেট পৌঁছে দেখি সব ৬০০ আর ৭০০ টাকার ইলিশ। তবে উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়া তা মোটেই মানায় না। বরং এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ আমার চাই। বাজার ঘুরে এক বিক্রেতার ডালায় চোখ পড়ল। বিক্রেতার তথ্য অনুযায়ী, দুটি ইলিশ মাছের একটির ওজন ১ কেজি আড়াইশো গ্রাম, অন্যটির ১ কেজি ৩০০ গ্রাম। তার অতিরিক্ত দামকে পাত্তা না দেয়ার ভান করে দু'একবার হাঁটা দিলেও অন্য মাছ বিক্রেতাদের ইলিশ দেখে মন ভরছিল না।  ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় নেমে হাসলেন বিক্রেতা। তবে তার ভাব ভাগের মতোই, নিলে নেন, না নিলে চলে যান।

এরপরও বরফ কিনতে ৪০ টাকা দিতে হলো তাকে। দুটি পলিথিনে বরফে মুড়িয়ে প্যাক করে দিলেন তিনি। আরো বললেন, এখন শুধু বিলোনিয়া নয়, কাতার, দুবাইও নিয়ে যাওয়া যাবে এই মাছ। যদিও পরে বর্ডার পার হতে হতে দেখি বরফ গলে পানি হয়ে গিয়েছে।

বন্দন দা'র স্ত্রী অসুস্থ। শুক্রবার রাতে যখন কথা হয়, মনে হচ্ছিল বেচারা স্ত্রীকে নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছেন। মনে হলো দাদা-বৌদি নিশ্চয়ই মাছ দেখে খুশি হবে। এর আগে যত ভারতীয় বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়েছে সকলেরই ইলিশের প্রতি ভালবাসার গল্প শুনেছি। একবার বেঙ্গালোরের অরুনজিতের গল্প শুনি কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে। ব্যবসায়ী ভদ্র লোক শখের গাড়ি চালক। বিয়ে করেছেন কলকাতার মেয়েকে। দেশ ভাগে তাদের বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছিল৷ অরুনজিত যখন বাংলাদেশে গিয়েছেন, তার স্ত্রী বারবার ফোন দিয়েছেন। বারবার জিজ্ঞাসা করেছেন, বাংলাদেশ দেখতে কেমন? অরুনজিতের স্ত্রীর নাম মনে নেই এখন। তবে তিনি স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন বাবা মায়ের কাছে শোনা গল্পের মতোই বাংলাদেশ দেখতে কিনা? অরুনজিতের স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, 'বাংলাদেশে ইলিশ মাছ খেয়েছো?' কেঁদে দিয়েছিলেন ভদ্র মহিলা৷ সে গল্প বলতে যেয়ে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়ে পড়ে পঞ্চাশোর্ধ অরুনজিতের।

সিএনজি থেকে পরশুরাম নেমে আবার রিকশা ধরি। এরপর ব্যাটারিচালিত অটো ধরি। অটোর সামনের সিটে বসতেই চালক জানতে চাইলেন ব্যাগে কি? উত্তরে ইলিশ বলাতেই যেন জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন, মনে হয়না বর্ডারে ইলিশ মাছ নিয়ে পার হতে দিবে৷ তারপরও দেখেন!

দেশ পার হতে বিজিবি'র কাছে এর  আগে আমাকে তথ্য দিতে হয়নি। তবে এখানে দিতে হলো। বিজিবি'র নতুন কর্মকর্তা জার্নালিস্ট ভিসা, আমার বিলোনিয়া দিয়ে বর্ডার পার হওয়ার কারণ, কিছুই গিলতে পারলেন না। আবার অনাত্মীয় না থাকলেও কেন সাব্রুম যাবো! সেই কথাও তাকে খুশি করতে পারলো না। তবে মাছ নিয়ে যেতে তিনি ছাড়লেও ভারতীয় বর্ডার সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিএসএফ ছাড়বেন কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। প্রায় ১০ মিনিটের বেশি লাগলো খাতায় আমার বিস্তারিত লিখতে।

এরই মধ্যে লুঙ্গি আর গায়ে টি শার্ট পড়া ২০ বছরের এক তরুণ এসে হাজির। আমার ইলিশের ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে বললেন, আপনাকে এগিয়ে দেই। বরফে বোঝাই ব্যাগটি আসলেই ভারী। আমি সাঁয় দিলাম। তিনি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন কাস্টমস অফিসে। ভ্রমণ ট্যাক্স দিতে হবে এখানে। তবে হলুদ টি শার্ট গায়ে দেয়া কর্মকর্তা খুব রিলাক্স ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে জানতে চাইলেন, 'আপনার অফিসের লেটার কই?' ভ্রূ কুঁচকে আমি জানতে চাইলাম, কিসের লেটার? বললেন, এই যে ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন, সেই লেটার। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও এসব প্রশ্ন করে মানুষকে হয়রানি করেন বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তারা। সে গল্প আমার জানা। বেশ বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম, 'ওটাতো ভিসার আবেদনের সময় লাগে, এখন লাগবে কেন!' আমার পাল্টা প্রশ্ন তার কাছে অপ্রত্যাশিত মনে হলো। আমতা আমতা করে তিনি বললেন, তাহলে শুনেন ট্যক্সতো সোনালী ব্যাংকে দিতে হয়। আপনি কাল সোনালী ব্যাংকে ট্যক্স জমা দিয়ে আসেন। আমার রাগ সত্যি আর ধরে রাখতে পারলাম না। বললাম, দেখেন আমি আখাউড়া দিয়েও বর্ডার পার হয়েছি৷ সেখানে তো কাস্টমসেই ট্যাক্স দিয়েছি। তিনি বললেন, আখাউড়া আর ফেনী এক নয়। এখানে শুধু রোগীদের জন্য ট্যাক্সের কাগজ দেই আমরা।

বললাম, দেখেন এখানে রোগী আসবে কেন! রোগীরা তো যায় ব্যাঙ্গালোর বা দিল্লীতে। আর আমি জানি ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা৷ আপনাদের একশো দুশো বেশি দিলেই আপনারা দিয়ে দেন। পাশে কম্পিউটারের সামনে বসা সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন তিনি।

যেন 'এইতো গাধা' লাইনে এসেছে। ডলার, রুপি, টাকার কথা শেষ করে তারা দুজনেই আসলেন ইলিশ প্রসঙ্গে! ২ কেজির বেশি ইলিশ মাছ নেয়া বৈধ হবে না। কোথায় অবৈধ করা হয়েছে দেখার জন্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আচ্ছা আমরাতো ছেড়ে দিচ্ছি। দেখেন ভারতে কিভাবে ঢুকাবেন! আমার চিন্তা হচ্ছিল, গরমে না আবার সব বরফ গলে যায়। অথচ এরা যেভাবে আয়েশি ভঙ্গিতে নাম ঠিকানা লিখলো তাতে ১০ মিনিটেরও বেশি সময় লেগে গেলো সেই ঘরে। জানতে চাইলো, মোবাইল কয়টি? বললাম, একটি। ওহ , আচ্ছা!

৫০০ টাকার ট্যাক্স ৭০০ টাকা দিয়ে হেঁটে গেলাম ইমিগ্রেশনে। পেছনে পেছনে ইলিশ বহনকারী ছেলেটি বলতে থাকলেন, 'স্যার, ওই দিকে ইলিশ নিয়ে যেতে না দিলে আমারে ডাক দিয়েন। আমার বন্ধুর বাড়ি দিয়ে পাড় করিয়ে দিবো, মাত্র ২০০ টাকা। কাস্টমসের বুথে লাল শার্ট গাঁয়ে দেয়া বেসরকারি সংস্থার চাকরিজীবিকে যেন রিমান্ডে নিয়েছেন ইমিগ্রেসন কর্মকর্তা। অফিস থেকে ছুটির কাগজ না নিয়ে আসায় ২৬ তারিখে আবার ভারতে বর্ডারে আসার বিদঘুটে প্রস্তাব দিচ্ছেন তিনি।

আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, কি আপনার? বললাম, ওপারে যাবো। ট্রাভেল ট্যাক্সের প্রিন্ট দেয়া রশিদ দেখে বললেন, এটাতো হবে না। আপনাকে ব্যাংকের স্লিপ দিতে হবে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, এটা এদের সিন্ডিকেট। বললাম, আপনি এটা কাস্টমসকে ফোন দিয়ে বলেন। আর আমার টাকাও ফেরত দিতে বলেন!

ভারত যাবেন কেন? প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, কেন নয়! এমনভাবে জানতে চাইছেন, যেন ভারত যাওয়া অপরাধ! আমার পেশা জানতে চাওয়ার পর গ্রামের বাড়ি জিজ্ঞাসা করলেন। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ বলা পর নিজের বাড়ি হাজীগঞ্জ বলে জানালেন। হাসতে হাসতে বললেন, 'আপনি আমার দেশি মানুষ।' এরপর যত দ্রুত আমার পাসপোর্টে সীল মেরে ওই রুম থেকে বের করে দেয়া। তাও খাতায় সব তুলে শেষ করতে ১০ মিনিটের ধাক্কা।

এই ভদ্রলোক জানালেন, দিনে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন ব্যাক্তি এই বর্ডার পাড়াপাড় হন। আমি বললাম, যেই অবস্থা তাতে সামনেতো এই সংখ্যা ৫ এ নামবে। আমি ত্রিপুরা ঢুকলে এরপর আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে পাড় হবো। বোঝা গেলো, এখানে পাড় হওয়া লোকের সংখ্যা কম বলে, যে কয়জনকে পাওয়া যায় তাদের হয়রানি করার শেষ মাত্রা সম্পর্কে জানেন এই কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশের তো কোন গেইট নেই এখানে। হাঁটা দিলাম ভারতের গেইটের দিকে। পেছনে পেছনে ইলিশের ব্যাগ হাতে তরুণ বললেন, 'স্যার আমাকে এখানে ছেড়ে দেন কিছু ঈদের বখশিস দিয়ে। তবে আমি আছি, ওখানে বিএসএফ মাছ নিয়ে ঢুকতে না দিলে আমাকে ডাক দিয়েন। আমি বন্ধুর বাড়ি দিয়ে পার করে দেবো। ২০০ টাকা দিলেই হবে। আমি তরুণের হাতে ২০ টাকা দিয়ে বিএসএফ চৌকির দিকে এগোলাম৷ আমার ব্যাগ খুলে কাঁপড় চোঁপড় বের করে চেক করলো। ব্যাগে পুতুল দেখে হিন্দীতে জানতে চাইলেন, এটা কেন? আমি ঠিক মতো প্রশ্নটা ধরতে পারলাম না। কমান্ডার অবাক বিস্ময়ে যেটা জানতে চাইলেন, সেটা বুঝতে পারলাম। ' ওমা! তুমি হিন্দী জানোনা!' ভাবলাম, উত্তর দেই যে তোমার কেন মনে হয়, সবার হিন্দী জানতেই হবে! চুপ থাকলাম। আমার ভারতে প্রবেশ করতে হবে। বন্দন দা, যীশু দা'রা অপেক্ষা করছেন। মাছের ব্যাগ চুয়ে পানি নিচে ভিজিয়ে দিচ্ছে।

ব্যাগের দিকে চোখ পড়তেই কমান্ডার জানতে চাইলেন, 'ব্যাগে কি?'

মাছ।

দ্রুত জুনিয়রকে হিন্দীতে বললেন, এই এন্ট্রি করো না। মাছ নিয়ে যাওয়া যাবে না।

আমি ইংরেজিতে বললাম, 'স্যার, আই হেভ সেইড টু মাই ফ্রেন্ডস দ্যাট টু ব্রিঙ্গিং হিলশা ফিশ ফর হিম! নাউ ইফ ইউ ডোন্ট অ্যালাউ ইটস শেইম ফর মি। প্লিজ স্যার, অ্যালাউ মি টু ক্যারি দিস।'

তিনি এক কথায় অনড়, মাছ নিয়ে ঢোকা যাবে না। আমি বললাম, মাছ চেক করেন। তবু ফেরত পাঠাবেন না। আমি ঢাকা থেকে এসেছি। পরশুরাম বা বিলোনিয়াতে আমার পরিচিত কেউ নেই যে তাকে মাছ দিয়ে দিবো! অনেক অনুনয় বিনয়ের পর কমান্ডার তার সিনিয়রকে ফোন দিলেন। তবে অনুমতি মিললো না। ওদিকে দুই বর্ডারের মাঝে লুঙ্গি পড়া যুবক ঘোরাফেরা করছেন। আমাকে ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন, তাকে ইলিশগুলো দিয়ে আসতে পার করে দেয়ার জন্য। আমার কেন জানি মনে হলো, এই যুবক এবং তার ব্যবসা সম্পর্কে দুই সীমান্তের সকল কর্তৃপক্ষই অবগত রয়েছেন৷ তবে ওপথ এবার মাড়াবোনা বলে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ আমি।

তবে কমান্ডার একটু নরম হয়ে আসলেন। আমাকে বললেন, বাংলাদেশের দিক থেকে তোমার পরিচিত কেউ এসে মাছ ফিরিয়ে নেয়া পর্যন্ত আমাদের চৌকিতে বিশ্রাম নিতে পারো। পেছনের দোকানে কিছু খেয়ে নিতে পারো। বললেন, ছোট বাটিতে একটু রান্না করে নিয়ে আসলেও ঢুকতে দিতাম। কিন্তু ২ কেজির বেশি এই মাছ নিয়ে যাওয়া যাবে না!

কমান্ডারের পরের কথায় তো আরো চমকে উঠলাম। বললেন, দেখো, বাংলাদেশের কাস্টমসতো তোমাকে ছেড়ে দিলো। মাছ নিয়ে হাসতে দিলো। কিন্তু ধরো তারাই এ পাড়ের কাস্টমসকে ফোন দিয়ে বলে দেন যে, একটা লোক পাড় হচ্ছে, তার কাছে দুটি ইলিশ মাছ রয়েছে। আমি এতো চালাক লোকদের ভিড়ে অসহায় বোধ করতে থাকি৷

ভারতের মোবাইল সিম নেই আমার কাছে। বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক আসে যায়।  ভাগ্যক্রমে নেট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যীশুদার নাম্বারে ফোন দিলাম। বন্দন দা ফোন রিসিভ করেই বললেন, চিন্তা করো না। আমাদের আর ২০ মিনিট লাগবে।

আমি চৌকিতে বসে আছি। জুনিয়র কর্মকর্তা তার হাতের ভারী সরঞ্জাম নিয়ে বাইরে এক চক্কর দিয়ে আসলেন। পরিস্কার বাংলায় জানতে চাইলেন, ইলিশগুলোর দাম কতো? বললাম, ৩ হাজার ৪০০ টাকা। অস্ফূট স্বরে বললেন, 'ওরে বাব্বা!' ঠিক করলাম, সত্যিই যদি ইলিশগুলো নিয়ে ঢুকতে না দেয়, তবে এই ভদ্র লোককে দিয়ে যাবো।

জানতে চাইলাম,আপনার বাড়ি কোথায়? শিলচর, বলেই আর কথা এগোলেন না। তবে কমান্ডারের সামনে  মনে হয় বেশি কথা বলা বারণ আছে। তার আগে শিলচরের কথা শুনে বললাম, আমিতো সেখানে গিয়েছি।  

কিছুক্ষণ পরই বন্দন দা, যীশু দা আর বিলোনিয়ার পৃত্থীব দা এসে পৌঁছালেন। উপরওয়ালাদের কাউকে ফোন দিয়ে মাছগুলো ছাড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। আমি পলিথিন খুলে উল্টে পাল্টে ইলিশ দেখালাম কমান্ডারকে। হাতে ইলিশের গন্ধ লেগে গেলো৷ আশপাশে পানি খুঁজতে থাকলাম হাত ধোঁয়ার জন্য।

বন্দন দা'র হস্তক্ষেপে ভারতীয় ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসে আর কোন ঝামেলা হলো না। তবে ধীর লয়ে খাতায় নাম ঠিকানা লেখতে তাদের কারোই ১০ মিনিটের নিচে সম্ভব হয় না। এখানকার ইমিগ্রেশনে এক ভারতীয় যুবক জানালেন, বাংলাদেশের প্রান্তে কাস্টমসে তাকে ট্রাভেল ট্যক্স দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা। অথচ যেটা ৫০০ টাকা। ভারতীয় কাস্টমস তার নিজের মোবাইল সেটের ব্রান্ডের নাম, মডেল, কোন দেশ থেকে কেনা হয়েছে, এসব জানতে চাইছে আর লিপিবদ্ধ হচ্ছে খাতায়।

সবুজের টিলা ধরে সাব্রুমের দিকে চলছি। ইলিশ মাছগুলো কেমন আছে! বরফ গলে একদম পানি ততক্ষণে। ১০০ মিটারের সীমান্ত পার হতে ৩ ঘণ্টা লাগলে ইলিশ কেনো শুধু দুই সীমান্তের বন্ধুত্বের দূরত্বটাও আরো বাড়িয়ে তুলবেন দুই পাড়ের কর্তৃপক্ষ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর