সাব্রুমের ধাম্মা দীপা স্কুল

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 08:21:58

সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা: সাব্রুমের পশ্চিমে, পূর্বে, দক্ষিণে বাংলাদেশ। উত্তরে আগরতলা শহর আর এরপর গেলে আসামের সীমানা। পুরানে রয়েছে, বিখ্যাত স্থপতি মায়াসুরার পরিকল্পনায় তিনটি শহর নিয়ে গড়ে ওঠে ত্রিপুরান বা ত্রিবুরাম। লোহা, ধাতু এবং স্বর্ণ দিয়ে তৈরি এই ত্রিপুরার অবস্থান পৃথিবী, আকাশ এবং স্বর্গে।

ঐতিহাসিকভাবে বক্সাঙ্গার এবং পিলাক যুগে এই অঞ্চলে বুদ্ধ ধর্ম চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও এখন মগ, চাকমা, বড়ুয়া এবং উচাইরা রয়েছেন শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। যা মূল জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশের মতো।

সাব্রুম থেকে উত্তরে ৮ কিলোমিটার পেরোলে হরিণা। মহাসড়ককে হাতের বামে রেখে টিলার পথ ধরতে হবে৷ উচুঁ নিচু সবুজে ঘেরা পাহাড়ি টিলার মাঝ দিয়ে এগোতে থাকলে দুদিকে রাবারের বাগান। এর ফাঁকে ফাঁকে নিচু জমিতে ধানের চাষ। মগ জনগোষ্ঠীর কর্মঠ নারীরা পাহাড় থেকে নেমে আসছেন। যীশু দা গাড়ি চালাচ্ছেন আর দুই বন্ধু মান্না ও বন্দনকে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে রাগিয়ে তুলছেন। এই তিন বন্ধুর খুঁনসুটি লেগে থাকে সারাদিন।

বন্দন দা বললেন, আমরা যে ধাম্মা দীপা স্কুলে যাচ্ছি, সেখানে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দালাই লামা এসেছিলেন। এখানে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষার্থী ছাড়াও বাংলাদেশ, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। শিশু শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও ইংরেজি মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষা প্রদান করা হয়।

ধাম্মা দীপা স্কুলের বিশাল মাঠ। দুপুরের সময়টায় শিক্ষার্থীরা ডাইনিংয়ে লাইন ধরে খাবার নিচ্ছেন৷ বন্দন দা মাস্টারকে খুঁজতে থাকেন। বলেন, উনি পুরো অঞ্চলের খুব শ্রদ্ধেয়।

এখানে ধর্মগুরু মংকের যে মূল প্রশাসনিক ভবনটি সেটি নির্মাণ করে দিয়েছে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ কমিউনিটি৷ নিচের প্রার্থনা কক্ষেই সেটির ফলক রয়েছে৷

দোতলায় পরম শ্রদ্ধেয় ড. ধাম্মাপিয়া একটি বিশাল টেবিলের সামনে বসে এইচপি ব্রান্ডের ল্যাপটপে কাজ করছেন। গেরুয়া রংয়ের ধর্মীয় পোশাকে মোড়ানো ব্যাক্তিটিকে দেখলে বুদ্ধিমান এবং প্রগতিশীল মনে হয়৷ পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর গল্পের ঝুড়ির ঢাকনা খোলেন ভিক্ষু। এখানে বহু জনা হিতায়া এডুকেশনাল ট্রাস্ট এবং ধাম্মা দীপা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদ ফেনী নদীর তীরে প্রত্যন্ত সুখনচরী গ্রামে বেড়ে ওঠা ধাম্মাপিয়ার। তবে বিদেশি শিক্ষায় দীক্ষিত এই ভিক্ষেুর বাংলা বলাতেও ইংরেজির টান পাওয়া যায়৷ 

ত্রিপুরায় বৌদ্ধ ট্যুরিজমের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি। নিজে বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ পূণ্য স্থানগুলো ঘুরে এসেছেন৷ আন্তর্জাতিক বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের নব নির্বাচিত মহাসচিব তিনি৷ বললেন, আগামী সেপ্টেম্বরে লস এঞ্জেলসে বৌদ্ধ ধর্ম এবং ব্যবসার ওপর একটি আর্ন্তজাতিক সেমিনারে অংশ নিতে যাচ্ছেন তিনি।

২০০২ সালে এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয়। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশে বিদেশে সুনামের সঙ্গে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন ভেবে গর্ব বোধ করেন ধাম্মাপিয়া৷ বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাতশ শিক্ষার্থী রয়েছেন।

গল্প জমে ওঠে ভিক্ষেুর সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে একটি বড় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের দপ্তরে কয়েক বছর আগেই সেই পরিকল্পনা জমা দেয়া হয়েছে। শুধু কাগজের বই নয়, একটি ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

ধর্ম আর ব্যবসার প্রসঙ্গ আসতেই মুচকি হাসলেন ধাম্মাপিয়ার। তিনি বললেন, দেখো, আলু আমরা অনেক ভাবেই খাই। আবার বিভিন্ন দেশে আরো অনেক প্রকারের রান্না হয় আলু দিয়ে। এখন এ বিষয়টিও নতুন। এটা হচ্ছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাগুলোকে কিভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সাহায্য করতে পারে এবং তা দিয়ে সাধারণ মানুষকে কিভাবে সাহায্য করা যায়, সে সবের পরিকল্পনা৷ এটা এমন নয় যে কিছু বিক্রি করা হবে।

ভিক্ষেুর রুম থেকে যখন বের হই আকাশে কাঠফাটা রোদ। বৌদ্ধের মূর্তি ঘুরে আসি। এখানকার স্বর্ণালি গেটের দুপাশে প্রহরীর মূর্তি হিসেবে সাপের মূর্তি রাখা হয়েছে৷ রোদের তেজে যেন তাদের আরো ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছিল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর