মাঝামাঝি থেকে দেখা মোহাম্মদ নাসিম

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 12:47:44

দিনটা ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ। আগের রাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেন থেকে ভারতের কাছে এক রানে হেরে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। খুব ভোরে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে রওনা করি আমরা। তৎকালীন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা পরীক্ষিৎ চৌধুরীর সঙ্গে বাসে আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। বাসে সকলের মুখেই গত রাতে ক্রিকেটে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ আর আক্ষেপ। আমরা যাচ্ছি টাঙ্গাইলে। কালিহাতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শেখ হাসিনা হেলথ কার্ড কর্মসূচীর উদ্বোধন করবেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সেই নিউজই কাভার করতে যাচ্ছি আমরা।

গাজীপুর পার হয়ে একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তার জন্য গাড়ি থামানো হলো। মন্ত্রীর গাড়িও এখানে থেমেছে। বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। দ্রুত নাস্তার টেবিলে বসে পড়লাম। গরুর পায়ার সঙ্গে  তন্দুর রুটি নিলাম আমি। তবে বিধি বাম! হাত থেকে মাংসের হাঁড় ফসকে পড়লো ঝোলে আর শার্টে ছিটকে আসলো। সাদা শার্টের অবস্থা হলো বেমানান। দ্রুত বেসিনে যেয়ে সাবান দিয়ে যতটুকু পারা যায় গায়ের শার্ট ধোয়ার চেষ্টা করলাম। এরপরও কি দাগ যায়!

নাস্তার পর্ব শেষে আবারো রওনা দেয়ার পালা। আমাদের সাংবাদিকদের কাছে আসলেন মোহাম্মদ নাসিম। জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি নাস্তা করা হয়েছে ঠিকমতো?' উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমার শার্টের দিকে চোখ গেলো মন্ত্রীর। বললেন, 'বোঝাই যাচ্ছে নাস্তা হয়েছে, তুমিতো দেখি শার্টকেও খাইয়েছো!'

সংবাদ সংগ্রহ করতে যেয়েই তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে আমার যতটুকু দেখা। উনার সঙ্গে খুব বেশি ব্যক্তিগত সর্ম্পক ছিল না, যতটুকু শুধু দেখেছি আর মন্ত্রী হবার পরপর একটি সাক্ষাৎকার নিতে যেয়েই যতটুকু আলাপ। এর বাইরে বলতে গেলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা বা কোন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা শেষে বের হওয়ার সময় সংবাদ নিয়েই দুই চারটি কথা। তাই কাছ থেকে বা দূর থেকে দেখা নয়, মাঝামাঝি দেখা থেকে মোহাম্মদ নাসিম সর্ম্পকে এই লেখা। সমালোচনার বাইরেও জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলীর সন্তান প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের আন্তরিকতা আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বরাবরই আকর্ষণ করতো।

২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ নাসিম যখন দায়িত্ব নেন, তখন একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল যে তিনি শুধু স্বাস্থ্য নিয়ে নয় বরং বক্তৃতায় রাজনীতির কথা থাকবে অনেক। বক্তৃতায় হাস্যরস করতে পারতেন যথেষ্ট। মঞ্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নুরুল হককে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার চোখের ডাক্তারের যেই অবস্থা, ভাল করে চোখে দেখি না! তেমনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও কি একই হাল!’ আবার পরক্ষণেই বলতেন, ‘নুরুল হক দেশের সেরা চক্ষু চিকিৎসক।’ বক্তৃতায় দরাজ গলায় স্বরের ওঠানামা করিয়ে সকলের মনোযোগ কেড়ে নিতেন তিনি। সাংবাদিকদের জন্য কোনটি সংবাদ হবে, সেটি খুব ভাল বুঝতে পারতেন।

২০০৯ সাল থেকে যতবার মোহাম্মদ নাসিমের অনুষ্ঠান কাভার করেছি, সবগুলোতেই তাকে দেখেছিলাম,  আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসেবে। তবে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেক বেশি সংবাদ কাভার করার সুযোগ হয়। একটা কথা প্রচলিত ছিল মোহাম্মদ নাসিমের ক্ষেত্রে। সেটি হচ্ছে, তিনি কোন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেন না। তবে সবখানেই দেরিতে পৌঁছাতেন।

২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো কোন হাসপাতাল পরিদর্শনে যাবেন তিনি। খবরটি শুনে আমিও দ্রুত চলে গেলাম জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, নিটোরে।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন ডা. আফম রুহুল হক। তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মোহাম্মদ নাসিম। পঙ্গু হাসপাতালের শয্যায় থাকা এক নির্মাণ শ্রমিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নাসিম। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, ‘আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’ এরপর খুব কৌশলে শ্রমিকের হাতের মুঠোয় গুঁজে দিলেন কিছু টাকা। এরপর লিফটের পথে হাঁটা দিলেন মন্ত্রী, পেছনে আবারো প্রায় অর্ধশত মানুষ।

এই ছিলেন রাজনীতিবিদ নাসিম। হাসপাতালে তার পদচারণায় যেমন রোগীদের মধ্যে ভাল লাগা ছিল, সমস্যাও তৈরি হচ্ছিল কিছুটা। সাময়িকভাবে হাসপাতালের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছিল।

তবে শ্রমিকের বেদনার মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা মনে হয় অনেক নামী-দক্ষ চিকিৎসকের পক্ষেও উপহার দেয়া সম্ভব হবে না। দেশের একজন মন্ত্রী এতো সন্তর্পনে হাতে টাকা গুঁজে দিলেন, যেন গোপনে একজন আত্মীয় আরেকজনকে সাহায্য করছেন।

এদিন হাসপাতালে মন্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তবে মিডিয়া এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের মূল আকর্ষণ ছিলেন নাসিমই।

চলনে-বলনে বেশ গম্ভীর ছিলেন এর আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী  দেশ সেরা সার্জন ডা. রুহুল হক। নাসিমের বহরে রাজনৈতিক নেতাদের প্রাধান্য যেমন থাকতো, তেমনি রুহুল হকের বহরে থাকতো চিকিৎসক নেতাদের হাতঘষা।

রাজনীতিবিদ মন্ত্রী এবং পেশাজীবী মন্ত্রীর মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করেছিলাম। এর আগে ২০১৩ এর অক্টোবরের ১৩ তারিখে হরতালে পিকেটারদের ছোড়া বোমায় চোখের কর্নিয়া হারানো রহিমাকে দেখতে চক্ষু হাসপাতালে যান তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক। তাঁকে দেখতে গিয়ে সব ধরণের চিকিৎসা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেদিন মন্ত্রী সব মিলিয়ে ২ মিনিটের বেশি কথা বলেননি পোষাকে মলিন রহিমার বাবা-মায়ের সঙ্গে। চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে পরিচালকের রুমে প্রবেশ করেন তিনি। চিকিৎসক নেতাদের আবদ্ধ হন তিনি। আবার পঙ্গু হাসপাতালে রোগীদের অস্ত্রোপচার হওয়া স্থান নিজ হাত দিয়ে ধরে বেশ মনোযোগী হয়েই পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছিল রুহুল হককে। কারণ তিনি চিকিৎসক হিসেবে বুঝতেন সেটি।

অন্যদিকে চিকিৎসাবিদ্যা সর্ম্পকে মোটেও ধারণা ছিল না নাসিমের। নিজেই ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, আমি এ সেক্টর সর্ম্পকে কিছুই বুঝি না। আমার পরিবারে একজনও ডাক্তার নেই। বিশেষ কিছুই জানি না। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

রুহুল হক পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। স্যুটেড হয়ে থাকতেন তিনি। গরমে প্রিন্টের শার্ট গায়ে দিতেন। হাসপাতালে পরিদর্শনে রোগীদের সঙ্গে কথা হতো কম। চিকিৎসক, শিক্ষক আর পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেই সারতেন পরিদর্শন।

তুখোড় রাজনীতিবিদ নাসিম পাঞ্জাবি আর হাতা কাটা কোটেই অভ্যস্ত ছিলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে পোশাক অনুসরণ করেন তারা।

বক্তব্যের সময় উচ্চারণে স্পষ্ট ছিলেন নাসিম। বক্তব্যে থাকতো রাজনীতির কথা। বিরোধীদলে প্রতি সতর্কবাণী। দলীয় নেতা কর্মীদের প্রতি দিক নির্দেশনা দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেও বক্তব্যে প্রফেশনাল টার্ম ছিল কম। সোজাসাপ্টা কথা বলতেন।

স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানেও রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনতেন নাসিম। তিনি নিজেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে নিজেই সাংবাদিকদের জরুরি বিষয়গুলো অবগত করতেন। সেখানে অন্য কারো স্থান ছিল না। অন্যদিকে রুহুল হক কিন্তু রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না। মন্ত্রীকে পেছনে ফেলে সেই সময়ে স্বাস্থ্য সেক্টরে বাক পটুতায় পরিচিতি অর্জন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলী।

বক্তব্যের সময় রুহুল হকের উচ্চারণ নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে ফিসফিস চলতো। বলাবলি হতো, তিনি মন্ত্র আওড়াচ্ছেন বিড়বিড় করে। কারণ অনেক কথাই বোঝা যেত না। বাংলা ইংরেজি মিশ্রণে বক্তব্য দিতেন বেশিরভাগ সময়। আর নাসিমের বক্তব্যে ইংরেজির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে।

করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে কাছের অনেককেই একটা কথা বলেছিলাম। মোহাম্মদ নাসিম আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকলে হয়তো এই দুরাবস্থায় আমরা পড়তাম না। কারণ উনার রাজনৈতিক স্বর ছিল অনেক শক্তিশালী। সেখানে আমলা বা অন্যরা তাকে এড়িয়ে যেয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াটা এতোটা সহজ হতো না!

আরো পড়ুন: সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আর নেই

এ সম্পর্কিত আরও খবর