চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান প্রতিদিনই দেশবিদেশে প্রকাশ পাচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার পাশাপাশি জানা যাচ্ছে সুস্থ হওয়া মানুষদের সংখ্যাও। এসবের বাইরে অঞ্চল, শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ ভেদে করোনার গতি-প্রকৃতি শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে তথ্য-পরিসংখ্যানের মাধ্যমে।
প্রথম দিকে প্রাপ্ত পূর্বাভাসে করোনায় শিশু ও বৃদ্ধরা অধিকতর আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ, এমন একটি কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সমীক্ষায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বে কর্মক্ষম জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশই করোনায় কো-মর্বিডিটির শিকার। এই তথ্যে করোনার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মক্ষম জনসংখ্যা অধিক। কর্মক্ষম জনশক্তি বলতে ধরা হয় ২৫ থেকে ৬৫ বছরের বয়সসীমার মানুষদের, যা উৎপাদনশীলতা নিরিখে ইতিবাচক, যারা রয়েছেন করোনার ঝুঁকিতে।
ভয়ের বিষয় হলো, এই কর্মক্ষম মানুষেরা করোনার থাবার বাইরে নেই। কারণ বিশ্বের নানা দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলেতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, এমন বলা চলে না। সকল নাগরিকের মতো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীও সাধারণ স্বাস্থ্যগত সমস্যার শিকার। করোনা তাদেরকে সুযোগ পেলেই আক্রান্ত করছে।
সর্বসাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনেকেই ত্রিশের কোঠা পার না হতেই অকালবার্ধক্যের শিকার হয়ে পড়েন। পেশা ও লাইফস্টাইলের কারণে বিভিন্ন অনিয়ম হেতু তাদের শরীরে বাসা বাঁধে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি ও হৃদরোগের মতো নানা অসুখ।
আরেকটি মারাত্মক তথ্যও সবার নজরে এসেছে। তা হলো, কোভিডের কারণে ইউরোপ-আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় সেসব দেশে বসবাসকারী দক্ষিণ এশীয়দের মৃত্যুহার প্রায় ২০ শতাংশ অধিক। কারণ হিসেবে ডায়াবেটিসকেই প্রাথমিক ভাবে দায়ী করা হয়েছে। দেখা গেছে, করোনাক্রান্ত শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অশ্বেতাঙ্গদের গড় বয়স কম এবং তাদের অন্যান্য জটিল অসুখও কম। কিন্তু তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ অত্যধিক বা তারা কমবেশি ডায়াবেটিস আক্রান্ত।
বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, উত্তর গোলার্ধে বসবাসকারী প্রায় ৪০ শতাংশ দক্ষিণ এশীয়ই টাইপ-ওয়ান অথবা টাইপ-টু ডায়াবেটিসের শিকার। করোনার ন্যায় মহামারির ক্ষেত্রে এসব অসুখ মৃত্যুহার অন্তত ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। করোনায় দক্ষিণ এশিয়া ও অন্যান্য অনুন্নত দেশেও মধ্যবয়সীদের অধিক মৃত্যুহার পরিলক্ষিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের সতর্কতামূলক পূর্বাভাস বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে।
ফলে করোনা প্রতিরোধের পটভূমিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী অনুযায়ী কর্মক্ষম মানুষদের নিয়মিত নজরদারিতে রেখে কো-মর্বিডিটির আশঙ্কা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
অবশ্য এক্ষেত্রে বাস্তবতা বেশ বিরূপ। কারণ, করোনার তীব্র প্রকোপে সম্পূর্ণ চিকিৎসা পরিকাঠামোই রাতারাতি মহামারি প্রতিরোধ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণ-আতঙ্কে বন্ধ বহু হাসপাতালের বহির্বিভাগ, চিকিৎসকের চেম্বার। গৃহবন্দি রোগীরাও রক্তচাপ, শর্করার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন না।
তদুপরি লকডাউন বা সামাজিক দূরত্বের কারণে অত্যাবশ্যক ওষুধের সরবরাহেও বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ লকডাউনে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রাত্যহিক খরচ বাঁচাতে রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের পরীক্ষা ও ওষুধ ক্রয় কমিয়ে দিতেও বাধ্য হচ্ছে। এমনই আত্মঘাতী পরিস্থিতিতে নীরব ঘাতক রূপে কিছু কিছু রোগ মানুষের শরীরে বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা করোনায় আক্রান্তের ক্ষেত্রে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন।
এসব মানুষের মধ্যে পেশাজীবী ও কর্মক্ষম মানুষই বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া বিশেষজ্ঞরা অল্পবয়সীদের মধ্যে ‘ক্রনিক মর্বিডিটি’-র অত্যধিক বৃদ্ধির আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। এসব রোগ যে নিঃশব্দ ঘাতক, তা সবার জানা। জাতিসংঘের ইএসসিএপি-র গবেষণাপত্রেও তেমনই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অথচ চলমান মহামারির সময় এসব বিষয়ে বাড়তি স্বাস্থ্য বিষয়ক সতর্কতা গৃহীত হয়নি।
এ কথা সবার জানা, করোনার মধ্যে ক্রমে ক্রমে পেশাগত ও আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষম মানুষদের কাজের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতেই হবে। তখন সংক্রমণের আশঙ্কাও তাদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাবে, মৃত্যুহার ও আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়বে, এমনই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ফলে করোনার বিরুদ্ধে চলমান অতি জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নীরবঘাতক রূপী রোগ, যথা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যার ব্যাপারে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে-বসা চিকিৎসকদের পেশায় তৎপর করে সাধারণ ক্লিনিক-হাসপাতালের নৈমিত্তিক কাজ পুনরায় সচল করতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহর এবং মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে এসব নীরব ঘাতক নামে চিহ্নিত রোগের চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ান না থাকলে নতুন নিয়োগের ব্যবস্থাও করতে হবে।
বাস্তবতা হলো এই যে, স্বাস্থ্যখাতের সবাই করোনাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত বলে অপরাপর রোগের জন্য স্বাস্থ্যসেবার হাল নাজুক, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়ানক জটিল করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তখন করোনার মতোই অন্যান্য রোগে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
বিশেষত কর্মক্ষম জনসংখ্যা সকল দেশের জন্যেই অমূল্য সম্পদ। তারা অধিকহারে আক্রান্ত হলে দেশের চালিকা শক্তির কাঠামো ভেঙে পড়বে। এতে যে আর্থিক-সামাজিক প্রভাব পড়বে, তা হবে অতি ভয়াবহ। ফলে এদেরকে অন্যান্য রোগের নিয়মিত চিকিৎসা সুযোগ দিয়ে সুস্থ-সবল এবং করোনার বিপদমুক্ত রাখাও বিদ্যমান স্বাস্থ্য-চিকিৎসা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বলে বিবেচনা করা কর্তব্য।