ডেঙ্গু সচেতনতায় করণীয়

, ফিচার

ড. মোঃ আসাদুজ্জামান মিয়া | 2023-09-01 23:18:32

১. উন্নয়নশীল বাংলাদেশে সু-স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হলো সচেতনতার অভাব। আমরা সল্পশিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত সবাই কম বেশি অসচেতন। সাধারণ থেকে অসাধরণ, গরিব থেকে ধনী প্রায় সকলের মধ্যেই একধরনের অসচেতনতা কাজ করে। বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে আমরাও বিপযর্স্ত। বিগত ৪-৫ মাস ধরে করোনার সাথে যুদ্ধ করে আমরা এখন অনেকটা ক্লান্ত। লকডাউনে থাকা বা নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার নিয়মনীতি এখন আমাদেরকে আর চিন্তিত করে না। আমরা অনেকেই এখন আর মুখে সুরক্ষা মাস্ক পরি না। বিষয়টা এমন যে কোথাও করোনা নেই। করোনার এই সময়ে আরেক দূর্যোগের হাতছানি তা হলো ডেঙ্গু। দেশে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ায় মশার উৎপাত চরম বেড়ে গেছে। আমাদের পরিবেশে এখন করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার চলছে। ইতিমধ্যে দেশে ৩০০ এর বেশি ডেঙ্গু রোগীর খবর পাওয়া গেছে।

গত বছর দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক। শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং ১৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল (তথ্যসূত্রঃ আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।

এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও এখন একটি ডেঙ্গুপ্রবণ দেশ। আর ডেঙ্গুপ্রবণ দেশে ফিবছর ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে যেমন- ফিলিপাইন, মালেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে এখন ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব চলছে। তাছাড়া বিশ্বের অনেক ডেঙ্গুপ্রবণ দেশই এখন ডেঙ্গু প্রার্দুভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যদি এ বছর এডিস মশা (এডিস এজিপ্টাই) সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডেঙ্গু ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। আর চলমান কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব একসাথে চললে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া আমাদের ডাক্তারসহ হাসপাতালগুলো এখন করোনা রোগী নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। মানুষ ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছে না। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। করোনা দূর্যোগে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদের সচেতন হতেই হবে এবং এমন অবস্থায় ব্যক্তিগত সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর বিকল্প নাই।

২. ডেঙ্গু রুখতে মশা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার এ বছর নতুন একটি স্লোগান চালু করেছে- প্রতি তিন দিনে একদিন, জমা পানি ফেলে দিন। বর্ষা শুরু হওয়ায় মশারা এখন দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। বৃষ্টির পানি আমাদের বাড়ির আশে পাশে বিভিন্ন জায়গায় যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাংকি, বালতি, টব, গাছের গুড়ির ফাঁকা জায়গা, আবদ্ধ নালা ইত্যাদিতে জমা থাকছে আর সেখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে মশার লার্ভা এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ মশা। তাই আমাদেরকে মশার লার্ভার উৎস ধ্বংসকরণ (সোর্স রিডাকশন) কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। লার্ভা জন্ম নেয়ার মুল জায়গাগুলো (বাসাবাড়ির সামনে বা ছাদবাগানে পানি জমে থাকে এরকম কিছু) চিহ্নিতকরে লার্ভার উৎস নিয়মিত ধ্বংস করতে হবে। বৃষ্টির পানি যাতে কোথাও জমতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। সিটি কর্পোরশনের লোকের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। লার্ভার সোর্স রিডাকশনের পাশাপাশি প্রয়োজনে আমাদের নিজেদেরকে মশার ঔষধ (লার্ভিসাইড) প্রয়োগ করতে হবে। মোটকথা আমাদের চারপাশে মশারা যাতে ব্যাপকভাবে জন্ম নিতে না পারে তার ব্যবস্থা আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে।

৩. তাছাড়া মশারা কিন্তু আমাদের ঘরের ভেতরেও বংশবৃদ্ধি করতে পারে যেমন- আমাদের বাসার ভিতরে ফুলদানি, রান্নাঘরে বা বাথরুমে জমে থাকা পানি, কলস বা বালতিতে রেখে দেওয়া পানি প্রভৃতিতে। তাই ঘরের ভিতরের এসব স্থানগুলো আমাদেরকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে মশারা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে। বাড়ির মহিলারা এ কাজে বেশি সচেতন হতে পারেন। ব্যক্তিগত সচেতনতা বাড়াতে মশা সর্ম্পকে আমাদেরকে কিছু সাধারণ জ্ঞান রাখতে হবে যেমন- কোন প্রজাতির মশা আমাদের জন্য ক্ষতিকর বা কোন মশা কখন কামড়ায়, মশাদের জীবনচক্র কেমন, কোথায় কিভাবে বংশবৃদ্ধি করে ইত্যাদি। মশা সম্পর্কে ধারণা থাকলে মশা দমন কিছুটা সহজ হবে।

৪. ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা প্রোটেকশন নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে মশার কামড় থেকে সুরক্ষিত রাখতে আরো বেশি সতর্ক ও যত্নবান হতে পারি। করোনাকালে বাসাবাড়িতে বেশি সময় থাকার কারণে এডিস মশা দ্বারা আমাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। করোনাকাল দীর্ঘ হলে এই সুযোগ আরো বাড়বে এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়বে। তাই এসময় ফুল-স্লিভস জামা পরিধান, ঘুমের সময় মশারি টানানো, দরজা-জানালায় নেট স্থাপন, সন্ধ্যায় বা সন্ধ্যার পূর্বে দরজা-জানালা বন্ধ রাখা এবং অপ্রয়োজনে না খোলা, বাজারের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রিপেলেন্ট ক্রিম, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে।

৫. মশা আমাদের জন্যে শুধু বিরক্তির কারণই নয় বরং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বটে। এটা আমরা খুব ভালো করেই জানি। তবুও আমরা অতটা সচেতন নই বরং মশা, মশাবাহিত রোগ, মশার দমনে আমরা অনেকটাই উদাসীন। মশা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা বেশী মনোযোগ দিয়ে থাকি। ডেঙ্গু হলে পরে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করি। কিন্তু এবছর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। মরণঘাতী করোনার কারণে এখন সাধারণ সব চিকিৎসাই প্রায় বন্ধ। হাসপাতালগুলো ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে পারছে না। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তাই এ বছর ডেঙ্গুর প্রতিকারের চেয়ে মশার প্রতিরোধই হবে যুক্তিযুক্ত। মশা নিয়ন্ত্রণ সফল করতে পারলে নিশ্চিত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমবে এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মশা দমনে আমাদেরকে বেশী মনোযোগী হতে হবে। আর এ জন্যে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নাই।

লেখক: ড. মোঃ আসাদুজ্জামান মিয়া, সহযোগী অধ্যাপক (কীটতত্ত্ব), পবিপ্রবি, বাংলাদেশ, ভিজিটিং সায়েনটিস্ট, এনাসটাশিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, ফ্লোরিডা, আমেরিকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর