হযরত মোবারক আলী (রহ.) ফকিরের আজান

, ফিচার

মোহাম্মদ আলম চৌধুরী | 2023-08-30 04:09:52

হযরত মোবারক আলী ফকির (রহ.) কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ও পেশ-ইমাম ছিলেন। তাঁর বাবাও বুজুর্গ ছিলেন। কেরামতিওয়ালা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর অলৌকিক কাহিনী নিয়ে বহু বয়ান আমি উখিয়ায় বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছি। চারজন সাক্ষীর কথা এখানে উল্লেখ করছি। যদিও তাঁরা সকলেই প্রয়াত। সাক্ষীরা হলেন- মরহুম মীর আহমদ সিকদার, মরহুম ফয়েজ আহমদ চৌধুরী (ওরফে ফয়েজ কোম্পানি), মরহুমা ছলেমা খাতুন (আমার নানী) ও স্বগীয় ডা. মুকুন্দবিহারী ধর (সাধু)।

একে তো বুজুর্গ পিতার সন্তান আবার তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও ধর্মকাজে নিজের জীবন উৎসর্গ- করা নিয়ে সকলের কাছেই তিনি গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তাঁকে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি রোমন্থন করার অভিপ্রায়ে অল্প কিছু লেখার চেষ্টা করেছি।

শৈশবে আমার নানার হাত ধরে উখিয়া স্টেশনে যেতাম। উখিয়ায় আমার নানার বাড়ি। সেহেতু নানা আর মামাতে ভরপুর উখিয়া স্টেশন। সবাইকে দেখে সিনার ছাতি আরও প্রসারিত হয়ে যেতো। নানা স্টেশনে বের হলেই আমি আসতাম। সকালে আর বিকেলে স্টেশনে আসা রুটিনকাজ ছিলো। আসহাব মিয়া সওদাগরের দোকান থেকে কেরোসিন নিতাম। পাশেই ছিল ইউসুফ আলী সওদাগরের পানের আড়ত। বাদশা মিয়া সওদাগরের দোকান থেকে পরোটা আর ডাল-ভাজি, কখনও চা-পরোটা খেয়ে ভোলাবাবুর দোকান থেকে পেঁয়াজ, রসুন আর নানীর জন্য শঙ্খমার্কা সরিষার তেল কিনে চলে আসতাম।

নানার সাথে স্টেশনে যাওয়ার সময় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে একটি মাটির গুদামঘর দেখলাম। আমি নানাকে এ ঘরটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। তখন নানার মুখেই শুনলাম অজানা বহু কাহিনী। এ দরগাহটি এখন নেই। নোংরা মোল্লা-রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে একজন বুজুর্গের কেরামত অজানা থেকে যাবে।

হযরত মোবারক আলী (রহ.) ফকিরের কণ্ঠে ধ্বণিত আজানে স্বর্গীয়সুধার মিশ্রণ ছিল। প্রাণের ভেতর আনচান করে উঠত। অধীর আগ্রহে থাকতাম কখন আজান ধ্বণিত হবে। চম্বুকাকর্ষণে ছুটে যেতাম মসজিদ পানে। যথাসময়ে তিনি আজান দিতেন। সাদা-জোব্বা আর মাথায় সাদা-পাগড়ি। মাটিতে এতো আস্তে কদম ফেলে হাঁটতেন যে দেখে মনে হতো তিনি যেন মাটির ব্যথা বুঝতে পারছেন। এতো মোলায়েম ব্যবহার আর সাধারণ জীবনযাপন তাঁর অসাধারণত্বের পরিচয় বহন করতো। দুনিয়ার প্রতি বিশেষ নিয়ামত হিসেবেই আল্লাহপাক এমন সজ্জন ব্যক্তিদের পাঠান।

মসজিদের উঠানে একটি গাবফল গাছ ছিলো। নিকসন মামা আমাকে নিয়ে যেতেন গাবফল খাওয়ার জন্য। নিকসন মামা বলতেন উঠানে ‘যেনো পাতা না পড়ে সেভাবেই নেবো জেঠা’। সেখান থেকে গাবফল নিয়ে আমরা চলে যেতাম। মসজিদ সম্প্রসারণের কারণে এখন গাবফল গাছ নেই।

সমবয়সী অনেকেই আমরা তখন মসজিদে পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করতাম। এতো যান্ত্রিক কোলাহলও তখন উখিয়ায় ছিলো না। প্রজন্মও এতো বিভ্রান্ত ও বৈষয়িক ছিলোনা। নীরব ঘুমন্ত আকাশ-বাতাসের বুক ভেদ করে মোবারক আলী ফকিরের আজান অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। মনের ভেতর আজানের স্বরে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যেতো। এক অবর্ণনীয় আনন্দে ছুটে আসতাম মসজিদে।

আমি তখন উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। রমজান মাস। তারাবির নামাজ আদায়ের জন্য আগেভাগেই ছুটে আসতাম। বড় নামাজ- দীর্ঘক্ষণ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পায়ে ব্যথা অনুভব করলে অস্থির হয়ে উঠতাম। তখন পেছনে এককোণে বসে বসে কয়েক রাকাআত আদায় করতাম। আর ভাবতাম, এ বুড়ো মানুষটি (মোবারক আলী ফকির) কিভাবে টানা নামায শেষ করেন। পুরো রমজান মাসে এভাবেই তারাবির নামাজ আদায় করতাম। শুধু তাই নয় সেহরি খাওয়ার পর ফলিয়াপাড়া রাস্তার ব্রিজের গোড়া পর্যন্ত সালাত সালাত বলে লোক ডাকতাম। কনকনে শীতের রাত। আবদুর রহমান মামাকেও দেখতাম মসজিদে চলে আসতে।

মসজিদের পাশেই দু’চালা একটি টিনের ছাউনিওয়ালা গুদামঘর ছিল। সেখানে তিনি বিশ্রাম নিতেন। একদিন যোহরের আজানের আগেভাগে গিয়ে আমি মসজিদের উঠান ঝাঁড়ু দিলাম। মূলত উঠানের গাবফল গাছের পাতা আর পুকুরপাড় সংলগ্ন কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছের পাতা পড়েই ময়লা হতো। সেদিন মসজিদে আগেভাগে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি তাঁর আজান দেওয়ার মুহূর্তগুলো অবলোকন করা। আমার আশা পূরণ হয়েছিল। তিনি যথাসময়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত কর্ণগতরে দিয়ে আজান শুরু করলেন। আল্লাহু আকবর ধ্বনির সময় তাঁর চেহারা মোবারক পরিবর্তন হয়ে গেলো। তাঁর পুরো শরীরে কম্পন দেখে আমি হতবাক। বুড়ো মানুষ। কণ্ঠস্বরে যে তেজ! এতো  শক্তির উৎস কোথায়? আমি এখনও ভাবি, আমৃত্যু ভাববো সেই মাহেন্দ্র ক্ষণগুলো।

বহু মসজিদ থেকেই আজানের স্বর ধ্বণিত হতো কিন্তু মোবারক আলী ফকিরের কণ্ঠ আলাদা। স্বতন্ত্র স্বর। দ্বীপান্বিত অবয়ব থেকে এ যেনো জ্যোর্তিময় ডাক। এ যেনো স্বর্গলোক থেকে ভেসে আসা অমৃতসুধাময় কন্ঠস্বর, যা মনকে আনচানকে করে। মসজিদের সাথে মানবমনের সংযুক্তির এ ছান্দসিক আহ্বান- উপেক্ষা করা সেদিনের এ-কিশোরের পক্ষেও অসম্ভব ছিল।

আমি এখনও উখিয়া গেলে প্রথমেই যাই কেন্দ্রীয় মসজিদে। সালাত আদায়ের পর কবরস্থানের পাশে দাঁড়াই। আমার প্রিয়জনেরা সেখানে চিরশয্যায় শায়িত। জিয়ারত যেনো শেষ হয় না। আপনজনদের চেহারাগুলো ভেসে উঠে মনের ভেতর। স্মৃতিগুলো তরতাজা হয়ে আমাকে আবেগাপ্লুত করে। মন তাঁদের একনজর দেখার অভিপ্রায়ে ব্যাকুল হয়। দুরত্ব মাত্র তিনহাত। চর্মচক্ষু অক্ষম। মনশ্চক্ষুতে সারি আমার আত্মীয়-দর্শন। ফিরে আসি ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে।

উখিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে থেকে তিনি ৪৮ বছর আল্লাহর রাহে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন। ১০৫ বছর বয়সে তিনি এ ধরাধাম ত্যাগ করেন। এ বছর (২০২০) তাঁর ১৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। তিনি উখিয়ার ঘিলাতলীপাড়া নিবাসী হযরত ফজর রহমান শাহ (রহ.) একমাত্র পুত্র ছিলেন।  

দেশে-বিদেশে বহু মসজিদে আল্লাহর রহমতে নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়েছি। বহু আজান শুনেছি। কিন্তু মোবারক আলী ফকিরের আজানই আমার হৃদয়ে ধ্বণিত হয়। কলিজা ধরে টানমারা এমন স্বর আমার কর্ণকুহরে আর কোথাও থেকে আসেনি। ‘আজান’ কবিতাটি মহাকবি কায়কোবাদ রচনা করেছেন।

কে ওই শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি।

মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।

কি মধুর আজানের ধ্বনি!

আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,

কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে

কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।

হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,

কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-

কত সুধা আছে সেই মধুর আজানে।

নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।

ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে

কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।

ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে,

আমি যেন শুনি সেই আজানের ধ্বনি।

আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,

ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,

প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আজান,

তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।

নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা,

এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,

মুয়াজ্জিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে

কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আজানে!

জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।

আহা কি মধুর ওই আজানের ধ্বনি।

মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।

লেখক: শিক্ষক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর