কামাখ্যাগুড়ির আদি কামাখ্যাধাম

, প্রবাসী

ড. রূপকুমার বর্মণ | 2023-09-01 12:25:03

বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সংস্কৃতিক ইতিহাসের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। এই পারস্পরিক সম্পর্কের বহু নিদর্শন দুই দেশের সীমানায় ছড়িয়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই এই নিদর্শনগুলি রয়ে গেছে ইতিহাসের গবেষনার পরিধির বাইরে। প্রথাগত গবেষকদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যাওয়া এমনই একটি নিদর্শন হল কামাখ্যাগুড়ির ‘আদি কামাখ্যাধাম’।

ভারত-ভূটানের কুমারগ্রাম সীমানা ক্ষেত্র থেকে ৩০ কিমি দক্ষিণে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের কুড়িগ্রাম-কোচবিহারের সীমানা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়ি গ্রামের এই ধাম (মন্দির ক্ষেত্র) পূর্বতন দেশিয় রাজ্য কোচবিহারের (১৫১৫-১৯৪৯) সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।

বাংলাদেশের পাঙ্গার ‘কোচ জমিদার বংশ’, আসামের ‘কোচ-হাজো’, ‘বিজনী’ ও ‘দরং রাজবংশ’ এবং জলপাইগুড়ির ‘রায়কত বংশের’ আদি ইতিহাসও আদি-কামাখ্যাধামের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। 

ভূটান হিমালয়ের পাদদেশে ডুয়ার্সের নদী-বেষ্টিত অঞ্চলে অবস্থিত কামাখ্যাগুড়ি বর্তমানে একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। এর উত্তর দিকের ৩১নং জাতীয় সড়ক ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল কামাখ্যাগুড়িকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রবেশদ্বারে পরিণত করেছে। ১নং রায়ডাক ও ২নং রায়ডাক নদী বৃহত্তর কামাখ্যাগুড়ি জনপদের যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্ব সীমানা দিয়ে কূলকূল করে বয়ে চলেছে। এছাড়াও কামাখ্যাগুড়ির প্রানকেন্দ্রের মরা রায়ডাক ও ঘোড়ামারা নদী বর্ষার জলে প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। কামাখ্যাগুড়ির দক্ষিণ দিক আটিয়ামোচর-বোচামারির জঙ্গলের মধ্যদিয়ে কোচবিহার জেলার সীমানা স্পর্শ করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই ভূটান, আসাম, কোচবিহার ও পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের সঙ্গে কামাখ্যাগুড়ির গভীর ঐতিহাসিক সংযোগ গড়ে উঠেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এই যে লব্ধপ্রতিষ্টা ঐতিহাসিকগন কামাখ্যাগুড়ির ইতিহাস অনুসন্ধানে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাই বলে কামাখ্যাগুড়ির কোন ইতিহাস নেই এমন মনে করারও কোন কারনও নেই।

কামাখ্যাগুড়ির প্রাচীন ইতিহাস নির্মানের জন্য আমাদের একটু ফিরে তাকাতে হবে কোচবিহার রাজ্যের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের দিকে। একটু বৃহত্তর দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে আমরা খুঁজে পাবো দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়ির আদি কামাখ্যাধামের সঙ্গে কোচবিহার রাজ্য তথা হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ ও নিম্ন আসামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযোগ।

মরা রায়ডাক, ঘোড়ামাড়া ও ২ নং রায়ডাক অববাহিকার রাভা ও কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠী অধ্যুষ্যিত দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়ির আদি কামাখ্যাধাম একটি প্রাচীন ধর্মীয় ক্ষেত্র। রাভা ও রাজবংশী ছাড়াও এই ধামের অতি নিকটেই মেচ জনজাতির বসবাস। ভারত-ভূটান সীমানার কুমারগ্রাম থেকে হেমাগুড়ি, মারাখাতা, খোয়ারডাঙ্গা, তেলিপাড়া ও ঘোড়ামারা ও উত্তর কামাখ্যাগুড়ি পর্যন্ত মেচ্‌, কোচ-রাজবংশী ও রাভা জনজাতির বসবাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায় মধ্যযুগীয় কামরূপী, বাংলা ও ফারসি ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক সাহিত্যগুলিতে। কোচবিহার রাজ্যের প্রকৃত স্থাপয়িতা মহারাজ বিশ্বসিংহের (১৫১৫-১৫৪০ খ্রি:) কামাখ্যা দেবী আরাধনার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় ‘দরং রাজবংশাবলী’ ও ‘রাজোপাখ্যানের’ মত ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলীতে। একইসঙ্গে মহারাজা নরনারায়ন (১৫৪০-১৫৮১ খ্রি) ও কোচ মহাসেনাপতি চিলারায়ের দ্বারা গৌহাটির নীলাচল পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দির নির্মানের গৌরবোজ্জ্বল পর্যায় চিত্রিত হয়েছে আসাম ও কোচবিহারের ঐতিহাসিক সুত্রগুলিতে। কিন্তু এই সুত্রগুলিতে কোথাও কামাখ্যাগুড়ির আদি কামাখ্যাধামের উল্লেখ নেই।

তাহলে আদি কামাখ্যাধামের সৃষ্টি কি করে হল? কোচবিহারের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কি? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের একটু দৃষ্টিপাত করতে হবে কোচ রাজ্যের সূচনা পর্বের উপর। একথা আজ সকলেরই জানা যে কোচ রাজ্যের সূচনা করেছিলেন মেচ দলপতি হাড়িয়া মন্ডল। ভূটানের হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমে ২নং রায়ডাক-সংকোষ অববাহিকা থেকে পূর্বে বড়নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ষোড়শ শতকের গোড়ায় হাড়িয়া মন্ডল মেচদের একটি সংবদ্ধ গোষ্ঠীতে পরিনত করেন। হাড়িয়া মন্ডল হীরা ও জীরা নামে দুই কোচ কন্যার সঙ্গে বিবাহ সুত্রে আবদ্ধ হয়ে কোচ রাজ্যকে সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলেন। কিন্তু মেচ-কোচদের নবোস্থিত শক্তি বাংলার সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) নিয়োজিত গোয়ালপাড়ার সুলতানী প্রতিনিধি তুরবকের কাছে ভয়ের কারন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হাড়িয়া মন্ডলের পুত্র বিশু (মহারাজা বিশ্বসিংহ), শিশু (রায়কত শিষ্যসিংহ), চন্দন ও মদনের নেতৃত্বে মেচ ও কোচদের যৌথ শক্তি তুরবককে পরাজিত করে গোয়ালপাড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল কোচদের অধীনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে মদন নিহত হলে চন্দনকে কোচ রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ও কোচবিহারের রাজশকের গণনা শুরু হয় (১৫১০ খ্রি)।

তবে কোচবিহারের ইতিহাসে বিশু বা বিশ্বসিংহকেই কোচ রাজ্যের প্রকৃত স্থাপয়িত রাজা হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বসিংহের রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কোচবিহার রাজদরবারে লিখিত বংশাবলী বা উপখ্যানগুলিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে হাড়িয়ে মেচের নেতৃত্বে মেচবা কর্ণপুর বা ফুলগুড়ির ভুইয়ার অধীনস্ত অঞ্চল আক্রমন করলে হাড়িয়া মেচ বন্দী হন। বিশু ও তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা নিম্ন আসাম সংলগ্ন অরণ্যে আশ্রয় গ্রহন করেন। কথিত আছে বিশু বনের মধ্যে একটি দশভূজা দেবী প্রতিমা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এক মেচ গৃহকত্রীর (মেচনী) ছদ্মবেশী দেবীর সহায়তায় “বহাগ বিহুর” দিন কর্ণপুরের ভূইয়াকে সহসা আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করে তার অঞ্চল দখল করেন বিশু।  ক্রমে ক্রমে অন্যান্য ভুইয়াদের পরাজিত করে এক বিশাল রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই দেবী আসলে কে ? বিশ্বসিংহ কোথায় এই দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান করলে আমাদের মনে হতে পারে যে এই অঞ্চলটি ছিল মেচ ও কোচ-রাজবংশী জনজাতি অধ্যুষিত নিম্ন আসাম (বর্তমান বোড়ো স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চল যেখানে হাড়িয়া মন্ডল তাঁর নেতৃত্বে মেচদের একতাবদ্ধকরনের প্রকৃয়া শুরু করেছিলেন)। তবে একটু গভীর দৃষ্টিতে ঐতিহাসিক সূত্র ও প্রমাণের উপর আলোকপাত করলে বোঝা যাবে যে বিশ্বসিংহ যেখানে দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন সেটা ছিল সংকোষ ও রায়ডাক নদীর মধ্যবর্তী মেচ, রাভা ও কোচ জনজাতি পরিপূর্ণ ভূটান হিমালয়ের পাদদেশ (বা কুমারগ্রাম -কামাখ্যাগুড়ি- শামুকতলা-তুফানগঞ্জ অঞ্চল)। এরকম মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। প্রথমত: নিম্ন- আসামের (গৌহাটির) বর্তমান কামাখ্যামন্দিরের পুননির্মান করেছিলেন বিশ্বসিংহ-পুত্র মহারাজা নরনারায়ন (১৫৪০-১৫৪৭ খ্রি) ও কোচ মহাসেনাপতি চিলারায়। দ্বিতীয়ত: বিশ্বসিংহ তাঁর রাজধানী তৈরি করেছিলেন হিঙ্গুলাবাসে (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলা শামুকতলা-মহাকালগুড়ি-কুমারগ্রাম অঞ্চল)। আলিপুরদুয়ারের চেকো নদী তীরবর্তী ‘চন্ডীর ঝাড়’ গ্রামে প্রাপ্ত বিশ্বসিংহ প্রবর্তিত মুদ্রা (১৯৮৬) আমাদের ধারনার পরিপূরক বলা যায়।

আদি কামাখ্যাধাম সন্নিহিত অঞ্চলের প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুসারে আজ থেকে প্রায় দুশ বছর পূর্বে কোচবিহারের কোন এক মহারাজার আদি কামাখ্যাধাম সংলগ্ন আটিমোচর-বোচামারির জঙ্গলে শিকার অভিযানের সময়ে তাঁর একটি হাতি সেখানকার কাঁদামাটিতে  আটকে যায়। স্থানীয় মানুষের পরামর্শে সেখানকার দেবী কামাখ্যার নাম স্মরন করে তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করতে মনস্থির করলে মহারাজার সেই হাতি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তখন থেকেই এই আদি কামাখ্যার আরাধানার প্রচলন হয়। গৌহাটির কামাখ্যামন্দিরের মতই এখানে অম্বুবাচীতে আদি কামাখ্যার পূজো হয়। এছাড়াও এখানে দুএকটি বিশেষ প্রজাতির বৃক্ষ আছে যা গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে কোচবিহারের মহারাজারা তাঁদের রাজ্যের অধীনস্ত আটিয়ামোচর–বোচামারীর জঙ্গলে তাঁদের রাজত্বের শেষ দিন পর্যন্ত (১৯৪৯) শিকারের প্রথাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অন্যদিকে মরা রায়ডাক ও ২নং রায়ডাক নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত আদি কামাখ্যাধামের মাটি ছিল অত্যন্ত নরম।  এখনও এখানে কোথাও কোথাও মাটিতে পা ঢুকে যায়।

কোচবিহার রাজ্যের গোড়াপত্তন, কোচ রাজাদের মৃগয়াক্ষেত্র ও তাঁদের ধর্মাচরনের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ থাকা সত্ত্বেও কোচ দরবারের ঐতিহাসিকগন আদি কামাখ্যাধামের গুরুত্ব অনুধাবন করেননি।

মুন্সী জয়নাথ  ঘোষ (রাজ্যোপাখ্যান), রিপুঞ্জয় দাস (মহারাজ বংশাবলী), ভগবতীচরন বন্ধ্যোপাধ্যায় (কোচবিহারের ইতিহাস) ও খাঁ চৌধূরী আমানতউল্লা আহমেদ [কোচবিহারের ইতিহাস, ১ম খণ্ড (১৯৩৬)]) বা অন্যান্য ঐতিহাসিকগন আদি কামাখ্যাধাম নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও কোচবিহার রাজ্য, বিশ্বসিংহ-পুত্র নরসিংহ স্থাপিত পাঙ্গার রাজবংশ, মুঘল আমলের উত্তরকূল ও দক্ষিনকূল, বর্তমান রংপুর বিভাগের অধীনস্ত বিভিন্ন জেলা, নিম্ন আসাম ও নিম্ন ভূটানের ইতিহাস রচনায় এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর