মাতৃভাষা দিবস ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন

, প্রবাসী

সাঈদ চৌধুরী | 2023-09-01 07:12:54

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। লন্ডনেও রয়েছে ব্যাপক আয়োজন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হবার পর ৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার জন্য আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় ছাত্র ও যুব সমাজ প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিক প্রমুখ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তখন শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে চালু হয় ভাষা শহীদ দিবস। তারপর অধিকতর মূল্যায়ন হয়েছে জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ভেতর দিয়ে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফোরাম ইউনেসকো বিশ্বের প্রতিটি ভাষার জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্তটি জানার পর কানাডীয় ১০ জনের একটি গ্রুপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের প্রচেষ্টা শুরু করেন। রফিকুল ইসলাম নামের প্রবাসী বাংলাদেশি ভাষাপ্রেমিক জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ করেন। এ প্রস্তাব তখন বাংলাদেশের পক্ষে ইউনেসকোতে পাঠানো হয়।


ইউনেসকো‘র সোশ্যাল এনথ্রোপোলজিস্ট আর ভাষাবিদেরা ব্যাপক গবেষণা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ইউনেসকোর ৩১তম এই সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এভাবেই আমাদের মাতৃভাষার জন্য আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়।

২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশ সমূহ তথা বিশ্বময় উদযাপিত হচ্ছে। লন্ডনেও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এখানে বাংলা ভাষার চর্চা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। ব্রিকলেন ‘বাংলা টাউন’ এখন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খ্যাত। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হলে চা রফতানির কাজে সিলেটের মানুষ লন্ডন যাত্রা শুরু করেন। এরপর জাহাজ শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে মানুষ এখানে পাড়ি জমিয়েছেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্যও এসেছেন অনেকে। ভ্রমণ, কর্মসংস্থান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েও হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও অসীম সাহসী সাধারণ মানুষে এখানে গড়ে তুলেছেন একের পর এক রেষ্টুরেন্ট। গত শতকে বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত প্রায় দশ হাজার রেস্টুরেন্ট এখন বৃটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমার সম্পাদিত বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম ঠিকানা ও ফোন নাম্বার সম্বলিত ‘ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি’তে এ বিষয়ে ব্যাপক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।

২০০৮ সালে আমি বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন শীর্ষক একটি গবেষণা গ্রন্থের কাজে বৃটিশ লাইব্রেরিতে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি। তখন বাংলা ভাষা ও বাংলা সাংবাদিকতা নিয়ে অনুসন্ধান কর্ম কতটা দ্রুহ ব্যাপার তা হাতে কলমে টের পেয়েছি। আমি তখন এশিয়ান ১৮ হাজার রেষ্টুরেন্টের ঠিকানা সহ ‘ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি’ প্রকাশ করি। এর মধ্যে সাড়ে নয় হাজার অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি মালিকানা প্রমাণ করেছি। বৃটিশ লাইব্রেরী এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সহ বৃটেনের মূল ধারায় ডকুমেন্ট হিসেবে এখন তা প্রযোজ্য। এছাড়া আমার সম্পাদিত ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশের তত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি ‘মুসলিম ইন্ডেক্স’ ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে। সেখানেও বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা স্থান পেয়েছে খুবই গুরুত্বের সাথে।

অনুসন্ধানে অবশ্য আরও অনেক মজার তত্ব ও তথ্য বেরিয়ে এসেছে। শুধু বাংলাদেশি নয়, বিদেশিরাও বাংলা নিয়ে গবেষণা করছেন। বাংলাদেশ প্রেমিক ড. উইলিয়াম রাদিচে বাংলা ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সোয়াস (স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) এর শিক্ষক। সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা হয়। অভিবাসিদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেয়ায় বৃটেনে বাংলা ভাষাও গুরুত্ব পাচ্ছে।


বিদেশিদের মধ্যে ইংল্যান্ডের জেমস কিথ, ড. সু লয়েড উইলিয়াম ও জেমস লয়েড উইলিয়াম এবং চেকাস্লাভিয়ার পন্ডিত কে সানি বাংলা ভাষাচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। এছাড়া বাংলা চর্চায় রাশিয়ার দানিয়েল চুক এবং মাদাম দিকোভা, জাপানের কাজিমো আজুমা এবং ৎসুইয়োসি নারা, চীনের দং ইউ চেন এবং ম্যা লি উন প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। এদের বাইরেও আরও বহু বিদেশি বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পঠন-পাঠনে বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যলয় অবদান রাখছে। ইউনিভার্সিট অব লন্ডন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, প্যাট্রিস লুলুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়, করাচি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক নামি দামি প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার গবেষণা হয়।

সম্প্রতি প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পঠন-পাঠন ও গবেষণা চালু হয়েছে। বিশ্বখ্যাত কেম্ব্রিজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষার চর্চা করে চলেছেন বেশ গুরুত্বের সাথে। বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে এসবই নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে।

বর্তমান পৃথিবীতে ২৯ কোটি লোকের ভাষা বাংলা। জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর ৭ হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে এর অবস্থান সপ্তম, মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ, আরও ১২ কোটি বাস করেন ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে। বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে এ-ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা। ফলে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে এর চর্চা ও পঠন-পাঠন।
বিলেতের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা শেখার দরকার পড়ছে সেদেশের নাগরিকদের। ক্রমবর্ধমান বাংলাভাষী মানুষের কারণেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চল এমনকি কানাডার কিছু এলাকার প্রধান ভাষা বাংলা। বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বায়নের এ যুগে যেখানেই সমাজবদ্ধ হয়েছেন, সেখানেই মুখরিত হয়েছেন নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চায়। এভাবেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বিশ্বময় বাংলা ভাষা।

এসব ইতিহাস যথাযথ ভাবে সংগ্রহ করা উচিত। এজন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। আরো প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট মন্ত্রনালয় ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের এম্বাসি ও হাইকমিশনে বিশেষ সেল। এ যাবত কালে যে কিছু কাজ হয়েছে, তা ইতিহাসের প্রাথমিক স্তম্ভ হিসেবে দাড়িয়ে গেছে। লন্ডনে আমরা যখন কোন মৌলিক বিষয়ে কাজ করি বা গবেষণা করি, তখন রিসার্চ কাজে অসংখ্য রেফারেন্স বুক ও জার্নাল পাওয়া যায়। তথ্যসূত্র (সাইটেশন) উল্লেখ পূর্বক আমরা তা কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু আমাদের ভাষা, সাহিত্য কিংবা সাংবাদিকতা নিয়ে তেমন কোন মৌলিক কাজ না থাকায় রেফারেন্স যোগাড় সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এটা অবশ্য সত্য যে, মৌলিক কাজের জন্য প্রয়োজন সময়, মনোযোগ এবং পরিশ্রম। সেই সাথে কৌতূহল বা জানার আগ্রহ। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তা নিয়ে বেশি দূর এগুনো যায় না। তবে সমাজের সুশীল অংশ যদি এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাহলে মঞ্জিলে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণতোরণে পৌঁছে দিয়েছে।

গত বছরের আগস্ট থেকে ইস্ট লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল ও বৃকলেন নিয়ে ৬ মাসব্যাপী একটি গ্রুপ ওয়ার্ক করেছি। সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। শত বছরের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন বয়সের নানা বর্ণের লোকজনের সাথে প্রতিদিন কথা বলেছি। নোট নিয়েছি বা রেকর্ড করেছি। ২০ বছর ধরে এখানে সাংবাদিকতা করছি। তারপরও অনেক বিষয় অধরাই ছিল। ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন সম্পর্কে নতুন করে বহু কিছু জানা হল। শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষনে বিলেতের কারী ক্যাপিটেল খ্যাত বৃকলেন ও ফাইনান্সিয়াল সিটি ক্যানারিওয়াফ এবং হোয়াইটচ্যাপেল কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম, আইরিশ, জুইস সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও প্রত্যাগমন এবং বাঙ্গালির বৃকলেন বিজয় ও বাংলা টাউন ঘোষণা মূল আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন সম্পর্কেও আলোকপাত হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন তথা হোয়াইটচ্যাপেল ও বৃকলেন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে উনাকিং পরাজিত ও জর্জ গ্যালাওয়ের বিজয়ী হওয়া এবং পরবর্তীতে রুশনারা আলী এমপি নির্বাচিত আর টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিলে নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের মহা তরঙ্গ। আলতাব আলি হত্যাকাণ্ড, ক্রসরেল ও খুদিলার আন্দোলন অনেকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে আলোচনায় এসেছে।

শেষ দিনে পনের জন স্থানীয় স্টেকহোল্ডার, দুইজন বৃটিশ, একজন ইউরোপীয় এ একজন জাপানি সমাজ বিকাশ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্য রেকর্ড করলাম। পূর্ব লন্ডনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংহতি নিয়ে মূলধারার এ কাজ অনেক দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে করতে হচ্ছে। ইমিগ্রেশন থেকে বর্ণ-বৈষম্য, খোলা বাজার থেক আধুনিক অট্রালিকা, এলএমসি, রয়্যাল লন্ডন হসপিটাল, ক্রসরেল -এই সবই গবেষণা কর্মের অংশ। তবে প্রতিদিন আসল কাজের বাইরে আরও কিছু সময় দিতে হয়েছে। কমিউনিটির অনেকের সাথে দেখা হয়, তাদের যাপিত জীবন নিয়ে কথা হয়। মাঝে মাঝে বেশ মজার এবং স্মৃতিময় ঘটনাও ঘটেছে।

বিলেতে আমাদের ইতিহাস চর্চার মূল্য অনেক বেশি। বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া সহজ। তবে বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয় সাপেক্ষ। আমার অনুসন্ধানে উনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হলে চা রফতানির কাজে সিলেটের মানুষ বিলেত যাত্রা শুরু করেন। এরপর জাহাজ শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে মানুষ বিলেত পাড়ি জমিয়েছেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্যও এসেছেন অনেকে। ভ্রমণ, কর্মসংস্থান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েও হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও অসীম সাহসী সাধারণ মানুষ বিলেতে গড়ে তুলেছেন একের পর এক রেষ্টুরেন্ট। গত শতকে বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত সাড়ে নয় হাজার রেস্টুরেন্ট এখন বৃটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের শতক অনেক আগেই পেরিয়েছে অভিবাসী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠি। বৃটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৪জন এমপি রয়েছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগম শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাউজ অব লর্ডসে আছেন পলা মন্জিলা উদ্দিন। বিভিন্ন কাউন্সিলে মেয়র ও কাউন্সিলর হয়েছেন বহু বাংলাদেশি। বৃটিশ বাংলাদেশি কূটনীতিবিদ আনোয়ার চৌধুরী বৃটিশ হাই কমিশনার হিসেবে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে ধর্ম ও ভাষা চর্চা চলছে সমান্তরাল ভাবে। বহুজাতিক সমাজের আবাসস্থল মাল্টিকালচারাল লন্ডন সিটিতে ১৩১টি স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। ভাষার দিক থেকে বাংলার অবস্থান এখন চতুর্থ।

বৃকলেন বাংলা টাউন বিলেতের মানচিত্রে একটা আইকনের মর্যাদা পেয়েছে। কিছু কিছু স্কুল-কলেজে জিসিএসই ও এলেভেলে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ একটা বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। বিলেতের মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে-মেয়েদের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে দ্বিতীয় কোন ভাষা পড়তে হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্মিদি স্ট্রিট স্কুলে পাইলট প্রজেক্টের অধীনে মডার্ন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে বাংলা পড়ানো শুরু হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে।
বাংলা টাউন থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় হয়েছে। মসজিদ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পার্ক সবখানে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। নিউহাম, ওয়েস্টহাম, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, মানচেষ্টার, কার্ডিফ ও নিউক্যাসলের মতো এলাকাগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নাম বাংলায় লেখা আছে ।

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আলোচনা ও জাতীয় দিবসগুলো বাংলা চর্চার প্রধান অবলম্বন। বাংলা সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলা ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চার লক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রবাসী স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিলেতে চলে এসেছেন।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু স্কুল, ওসমানী স্কুল, কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, আলতাব আলী পার্ক, বাংলাদেশ সেন্টার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাঙ্গালি জাতি ও বাংলা ভাষার পরিচয় ধারণ করে আছে। ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষায় এবং এনএইচএস হাসপাতালগুলো ভয়েস ডিরেকশনে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নির্দেশনা চালু হয়েছে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও সিলেটি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। অসংখ্য লাইব্রেরিতে এখন বাংলা বই গুরুত্বের সাথে রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ বিশেষ ভাবে বিদেশিদের বাংলা চর্চায় উৎসাহ যুগিয়েছে। বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের জন্য বাংলার প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের আলেক্সজান্ডার প্যালেসে ডক্টর ইউনুসকে দেয়া সম্বর্ধনা সভায় বৃটিশ ও ইউরোপীয় এমপিসহ প্রায় ২ হাজার মানুষের উপস্থিতি ও ইউরোপীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার এরই প্রমান বহন করে। বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, মস্কো রেডিও, রেডিও ভেরিটাস, কানাডার বাংলা রেডিও চ্যানেল সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

বিলেতে অধ্যয়ন শেষে অনেক বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। দেশ থেকেও অনেকে গিয়েছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার দেশে দেশে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য। ফলে সেসব স্থানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, টেকনোলজিক্যাল গ্লোবালাইজেশন মানবজাতির ভাষাকেও বিশ্বায়িত করে তুলছে দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি সিয়েরা লিয়ন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এভাবেই বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।

দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের ফলে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। রাজনীতিতে আপন কর্মদক্ষতা গুণে অনেকে লাভ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি। এতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশি জাতির মর্যাদা বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন, বিশ্বে জনমত গঠন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করে প্রবাসিরা বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এভাবে বিলেতে বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
* লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর