স্লোভেনিয়ায় বিড়ম্বনায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

, প্রবাসী

রাকিব হাসান, স্লোভেনিয়া থেকে | 2023-08-31 17:23:57

দক্ষিণ মধ্য ইউরোপের দেশ ‘স্লোভেনিয়া’। যার আয়তন ৭৮২৭.৪ বর্গমাইল। দেশটির আয়তন যেমন খুব বেশি বড় নয় তেমনি দেশটিতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়। প্রায় একুশ লাখ জনগোষ্ঠীর দেশটির উত্তরে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ইতালি, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলবেষ্টিত। 

যদিও স্লোভেনিয়া বলতে গেলে নতুন একটি রাষ্ট্র তবুও শিক্ষাক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। স্লোভিন দেশটির প্রধান ভাষা হলেও প্রায় সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। ইফ ইংলিশ প্রফিসিয়েন্সি ইনডেক্স অনুযায়ী স্লোভেনিয়ার স্কোর ৬৪.৪৮ যা সারা পৃথিবীর মধ্যে নবম এবং এক সময় কমিউনিজম শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিলো এমন দেশগুলোর মধ্যে প্রথম। নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার পরপরই স্লোভেনিয়ার অবস্থান।

ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা, ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, ইউনিভার্সিটি অব প্রিমরস্কা দেশটির উল্লেখযোগ্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানা এবং ইউনিভার্সিটি অব মারিবোর আন্তর্জাতিক যে কোনও সূচকে সারা পৃথিবীর প্রথম পাঁচশোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে স্থান পেয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যখন কেউ বাইরের কোনও দেশে আসার জন্য পরিকল্পনা করে প্রথমে তার মাথায় যে বিষয়টি কাজ করে সেটি হচ্ছে ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার এবং এ ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া অনেকটাই নমনীয়।

দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর, মাস্টার্স বা পি.এইচ.ডি সকল ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডিগ্রি প্রোগ্রাম পাওয়া যায় ইংরেজিতে এবং এখনও ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় স্লোভেনিয়াতে অনেক কম খরচে পড়াশুনা করা যায়। স্লোভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনও লেভেলে পড়াশোনা করতে হলে এক বছরে টিউশন ফি ২,৮০০ ইউরো থেকে ৪,০০০ ইউরোর মতো প্রয়োজন এবং দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয়ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক কম। আবার আমাদের দেশ থেকে যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে আসতে চান অনেকের মাঝেই পার্টটাইম চাকরির চিন্তা-ভাবনা কাজ করে এ ক্ষেত্রেও স্লোভেনিয়া অনেকটা নমনীয়। ‘এম জব সার্ভিস’ এবং ‘ই-স্টুডেন্ট সার্ভিস’ নামে দুইটি অর্গানাইজেশন রয়েছে যারা শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম চাকরির ব্যাপারে সহযোগিতা করে থাকে । এই দুইটি অর্গানাইজেশন স্লোভেনিয়ার প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত। এছাড়াও রয়েছে ‘বনি বা সাবসিডাইজস মিল’ এবং ‘সাবসিডাইজস বাস সার্ভিস’ নামে দুইটি বিশেষ পরিষেবা যেখানে আপনি একজন স্টুডেন্ট হিসেবে অনেকটা সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার কিংবা গণপরিবহন ব্যবহারের সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।

কাজেই এটা বলা যায় যে যদি কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে বাইরের দেশে আসতে চান বিশেষ করে ইউরোপে। তাদের জন্য স্লোভেনিয়া হতে পারে একটি উল্লেখ করার মতো জায়গা। আরও একটি সমস্যার সম্মুখীন হন অনেকে ইউরোপে আসার পর, আর সেটা হচ্ছে বছর শেষে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রি-নিউ করার ক্ষেত্রে এবং এদিক থেকেও স্লোভেনিয়াতে এখন পর্যন্ত তেমন জটিলতা নেই। যদি আপনি শিক্ষার্থী হন আপনাকে আপনার ইউনিভার্সিটি থেকে একটি লেটারের ব্যবস্থা করতে হবে যা আপনার স্টুডেন্ট স্ট্যাটাস সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করবে সে লেটার এখানকার স্থানীয় ইমিগ্রেশন অফিস বা উপরাভনা এনোটাতে জমা দিলেই আপনি আপনার টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রি-নিউ করার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

স্লোভেনিয়াতে এতো সুযোগ-সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্লোভেনিয়াতে স্টুডেন্ট জবের ক্ষেত্রে কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক এ সকল দেশের আইনে বলা আছে যে একজন শিক্ষার্থী সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে পারবে না কিন্তু স্লোভেনিয়াতে সে রকম আইন নেই। তাই এখানে চাইলে যে কেউ যে কোনও সময় ফুলটাইম কাজও করতে পারেন। তবে আপনার আয়ের একটি অংশ অবশ্যই সরকারকে দিতে হবে ট্যাক্স বাবদ। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া এমনকি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ারও কিছু দেশ যেমন- পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ এমন কিছু দেশ আছে যে সকল দেশের নাগরিকদের কেউ যদি স্লোভেনিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন তাহলে তাকে ট্যাক্স দিতে হয় না যদিও দিতে হয় তাও আবার নামমাত্র । এর কারণ হচ্ছে এ সকল দেশের সরকারের সাথে স্লোভেনিয়ার সরকারের দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি আছে। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীকে ট্যাক্স প্রদান করতে হচ্ছে।

আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দূরত্ব। স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস না থাকায় যে কোনও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে যাবতীয় কাজ করতে হয়। টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রি-নিউ কিংবা অনেক সময় ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশনের কাজের জন্য ডকুমেন্ট স্লোভেনিয়ার সংশ্লিষ্ট মিনিস্ট্রি কর্তৃক লিগালাইজেশন করতে হয় এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি থেকে প্রথমে ডকুমেন্ট সত্যায়িত করা। ভিয়েনার বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি এ সকল ডকুমেন্ট সত্যায়িত করলেই স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি সে সকল ডকুমেন্ট লিগালাইজেশনের জন্য গ্রহণ করবে। লুবলিয়ানা থেকে স্লোভেনিয়ার দূরত্ব প্রায় চারশত কিলোমিটারের ওপরে এবং বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা যেতে সময় লাগে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে ভিয়েনাতে যাওয়া-আসা কঠিন এবং যাতায়াতে খরচও হয় অনেক বেশি।

স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের একটি অনারারি কনস্যুলেট থাকলেও নানাবিধ কারণে সেটি দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এছাড়াও কারও যদি টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট কিংবা পাসপোর্টের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে থাকে অথবা কোনও ডকুমেন্টে কোনও সমস্যা যদি থাকে তাহলে তার পক্ষে অস্ট্রিয়া পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, এতে অনেকটা প্যারাডক্সের মতো একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে তিনি ভিয়েনাতে যেতে পারছেন না অন্যদিকে ভিয়েনাতে না গেলে তিনি তার সমস্যার সমাধানও করতে পারছেন না।

বাংলাদেশ সরকারের সাথে স্লোভেনিয়ার সরকারের একটি চুক্তি এখন সময়ের দাবি এবং আশা করি বাংলাদেশ সরকার স্লোভেনিয়ার সরকারের সাথে এ বিষয়ে চুক্তি করলে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীর ৩৪% থেকে ৪০% ট্যাক্সের একটি বিশাল বোঝা থেকে অনেকটা নিষ্কৃতি পাবে। যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি। সেই সাথে অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীও শিক্ষাবৃত্তিসহ এখানে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পি.এইচ.ডি. এর সুযোগ পাবে। স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি স্থায়ী এবং কার্যকরী কনস্যুলেট অফিস প্রয়োজন যাতে ডকুমেন্ট লিগালাইজেশন কিংবা অন্য কোনও প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সেবা আমরা এ কনস্যুলেট অফিস থেকে পেতে পারি। এ সকল সমস্যা সমাধান করতে পারলে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরাও গবেষণা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে স্লোভেনিয়ার বুকেও বাংলাদেশের সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আশা করি এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার খুব শিগগিরই দৃষ্টি প্রদান করবেন এবং সকল সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর