সুসময়ের প্রতীক্ষায়

, প্রবাসী

তাহমিনা বেগম | 2023-09-01 20:37:06

৩১ মে ভোরবেলায় ফজরের আজানে শুনলাম সেই চিরপরিচিত, আজন্ম শুনে আসা বানী, ‘হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ’।মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকে সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে সালাতের জামাত নিষিদ্ধ করা হয়, আজানে শোনা যেতে থাকে এক অদ্ভুত বানী, ‘সাল্লু ফি বুয়ুতি কুম’। যা মানুষের জীবনের অস্বাভাবিকতাকেই নির্দেশ করে। যে আজানে শুনে এসেছি মসজিদে যাও্য়ার আহবান সেই একই আজানে বলছে ঘরে থাকতে, ঘরে সালাত আদায় করতে। মুসলিম জাতির জন্য এ এক কঠিন পরীক্ষা। তাই আজ যখন আজানে আবার আহবান করা হচ্ছে মসজিদে যেতে, মুয়াজ্জিন আবেগ আপ্লুত হয়ে সালাতের ইকামত দিচ্ছেন, তখন যদিও জানি দু’মাসে পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি, তবুও মনে আশা জাগে মানুষ হয়তো আবার তার পুরনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে।

৩১ মে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয় মসজিদে নববীর দরজাও। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করেন। তাদের চোখে মুখে ছিল আনন্দ, আবেগ, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর করোনা মহামারি থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা। তারা ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে রইলেন।

রমজান মাসে সৌদি আরবের মসজিদগুলো থাকে সবচেয়ে ব্যস্ত। প্রায় সব মসজিদেই থাকে ইফতারের আয়োজন। এশার নামাজের পর তারাবিহ, যেখানে পুরুষদের সাথে মহিলারাও অংশগ্রহণ করেন। শেষ ১০ দিন রাত ১ টা থেকে শুরু হয় শব-ই-কদরের নামাজ। এখানে মসজিদ থেকে ইমামের কেরাত শোনা যায়। তাই সারারাতই সরব থাকে প্রতিটি মসজিদ এবং এর আশেপাশের এলাকা। কিন্তু, এ বছর পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এশার আজানের পরই চারিদিকে সুনশান নীরবতা। কারফিউ এর কারণে রাস্তা থেকে ভেসে আসতো না কোন যান চলাচলের শব্দ। এ পরিস্থিতি্তেই উদযাপিত হলো ঈদ। এ দেশে ঈদের প্রধান আকর্ষণ হলো দিনের শুরুতে ঈদের জামাত। পরিবারের সবাই ঈদগাহে গিয়ে এই জামাতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু, এ বছর সবাই নামাজ পড়লো যার যার বাসায়। শুধু মসজিদ থেকে শোনা গেল তাকবির। এটাই ছিল একমাত্র সান্ত্বনা।

মসজিদে নববীর গেট খোলা রাখা হয়েছে

একশ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ। প্রথমধাপে এর প্রভাব ছিল অপেক্ষাকৃত মৃদু, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃতের সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আমাদের বিশ্বনেতারা তখন  ব্যস্ত ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে। মহামারি ছিল তাদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এমনকি জনগণ যেন মহামারির সঠিক খবর না পায় সেটা নিশ্চিত করতে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে সংবাদপত্রের ওপর ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ। শুধুমাত্র স্পেন যেহেতু যুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল তারা গুরুত্বের সাথে এই ভাইরাসের খবর প্রকাশ করে। তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নেতারা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসাবে স্পেনের নাম ঘোষণা করে এবং ভাইরাসটির নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু। ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল ছিল মূলত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সেনাক্যাম্পগুলো এবং সেনাদের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। ভাইরাসের উৎপত্তি হয়তো মানব জাতির হাতে নেই কিন্তু, একে মহামারিতে পরিণত করার দায় সে কখনো এড়াতে পারবেনা।

একশ বছর পরেও আমাদের পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। একশ বছরে জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে উন্নত হয়েছে বিশ্ব, হয়ত তুলনামূলকভাবে খুব দ্রুতই করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে পরিবর্তন হয়নি মানুষের চরিত্রের। বিশেষজ্ঞদের মতামতের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে রাজনৈতিক কৌশল। এখনও বিশ্বনেতাদের হঠকারিতা, নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বহীন, অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

মসজিদে নববীতে নামাজ আদায়

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বার বার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশ লকডাউন তুলে নিচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরত্ব দেয়া হচ্ছে অর্থনীতিকে। প্রশ্ন হচ্ছে জীবন আগে না জীবিকা আগে? এই সমীকরণের সমাধান খুব জটিল না। জীবিকা না থাকলে জীবিকার ব্যবস্থা করা যায়, অন্য কারো সাহায্য নেয়া যায়। কিন্তু জীবন না থাকলে? প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা। যারা তাদের প্রিয়জন হারাচ্ছেন তাদের কাছে এ শুধু সংখ্যা নয় চরম বাস্তবতা, অপূরণীয় ক্ষতি যা কোন কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

মুয়াজ্জিনের ভোরের আজানের সাথে যেমন কেটে যায় রাতের কালো অন্ধকার তেমনি করোনার অন্ধকার কেটে আমাদের জীবনও হয়ে উঠবে নিশ্চিন্ত, স্বাভাবিক। মুসল্লিরা মসজিদে যাবে, বাচ্চারা স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হবে, আ্তঙ্ক ছাড়া কাটবে মানুষের দিন ও রাত। চরম অব্যবস্থাপনা, চোখের সামনে অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে করতে প্রিয়জনের মৃত্যু, হাসপাতালের বারান্দায় মরদেহের মিছিল পেছনে ফেলে একদিন ভোর হবে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে সেই সুস্থ, নির্মল ভোরের প্রত্যাশা নিয়ে।

তাহমিনা বেগম, অধ্যাপক, কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়, আভা,সৌদি আরব

এ সম্পর্কিত আরও খবর