ককেশাসে যুদ্ধের দাবানল

, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:48:04

ইউরোপ আর এশিয়াকে বিভাজিত করেছে ককেশাস নামের যে অঞ্চল, তার একদিকে কৃষ্ণ সাগর ও আরেক প্রান্তে কাস্পিয়ান সাগর। ককেশাস পর্বতমালা এ অঞ্চলে অবস্থিত, যার শৃঙ্গ এলব্রুস ইউরোপের অন্যতম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ককেশাস পর্বতমালা একটি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক রূপে পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ট্রান্স-ককেশিয়া ও আনাতোলিয়া অঞ্চলকে প্রাকৃতিক ভাবে বিভক্ত করেছে।

ককেশাসের নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকাটিকে কেন্দ্র করে দুটি দেশ, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সংষর্ষে লিপ্ত। দেশ দুটির সংষর্ষের পেছনে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও পরোক্ষ ভাবে ইন্ধন দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, সঙ্কটের সূচনা সোভিয়েট আমলে, যখন এলাকাটি কমিউনিস্টরা দখল করে।

তুরস্ক ককেসাসের বিষয়ে খুবই আগ্রহী, কারণ এলাকাটি এক সময় তাদের উসমানিয়া বা অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ককেসাসের নিকট-প্রতিবেশী ইরানও ঘটনাপ্রবাহে নিরব নেই।

ফলে ককেশাসে যে সামরিক মেরুকরণ হয়েছে, তাতে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া মুখোমুখি হলেও রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অর্থোডক্স খ্রিস্টান রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সাহায্য করছে রাশিয়া আর শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আজারবাইজানকে সাহায্য করছে সুন্নি তুরস্ক। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, শিয়া-ইরান শিয়া-আজারবাইজানকে নয়, সাহায্য করছে খ্রিস্ট আর্মেনিয়াকে।

ককেসাসের মানচিত্র

প্রচুর খনিজ, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি ককেসাসের প্রতি প্রতিবেশী সবগুলো দেশেরই দৃষ্টি রয়েছে। তা ছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে ককেসাসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংযোগই শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ভৌগোলিক প্রান্তে যাতায়তের জন্য ককেশাস ঐতিহাসিক সময়কাল থেকেই তাৎপর্যবাহী বলে বিবেচিত।

কিন্তু ককেশাসের ভূ-রাজনীতিতে বিচিত্র সামরিক মেরুকরণ কেন? সুন্নি সাহায্য করছে শিয়াকে আর শিয়া খ্রিস্টানকে? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ধর্ম বা মতাদর্শের চেয়ে স্বার্থই এর পেছনে পালন করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের সম্পর্ক আগাগোড়াই ভালো। ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি শিয়া রাষ্ট্রশক্তি দাঁড় করাতে চায় সুন্নি তুরস্ক। আর ইরান চায় না পাশেই একটি নতুন শিয়া শক্তির উত্থান হোক। তাছাড়া রাশিয়া-আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের স্বার্থের বন্ধন সুদৃঢ়। ফলে ককেশাসে তৈরি হয়েছে এমনই জটিল মেরুকরণ।

নবতর বিন্যাসের কারণে ককেসাসের মাটিতে অতীতের মতো সীমিত লড়াই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। অস্ত্র, মারণাস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে যুদ্ধরত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়াকে। আপাত শান্ত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় ককেসাসে সর্বাত্মক যুদ্ধের নেপথ্যের কারণও এই আঞ্চলিক সামরিক-রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে নিহিত, যাতে বড় আকারের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে এবং শান্তির নানা উদ্যোগ বার বার ব্যর্থ হয়ে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

মনে হচ্ছে, ককেসাস ও মধ্য এশিয়ায় প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সেই ইতিহাসের, যা একদা প্রকম্পিত করেছিল সারা বিশ্ব। মধ্যযুগে যে অঞ্চলের সেনাপতিগণ যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীময়, সে আগুনই এখন জ্বলছে তাদের আবাসস্থলে।

কারণ, ইতিহাস এক রংদার রেশম তন্তু, সুতার টানে ঘুরেফিরে চলে আসে বার বার। আরব্য রজনীর গল্পের মতো তারও এক গল্প থেকে অন্য গল্পে বয়ে চলা স্বভাব। গুটিপোকার গায়ের রোঁয়া জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি সিল্ক, দুই কুঁজওয়ালা উটের পিঠে চেপে পুর্বের চীন থেকে পশ্চিমে রোম পর্যন্ত পাড়ি দেয় এক দীর্ঘ পথজালিকা ধরে। সে পথ বেয়ে ফিরে আসে কাচের বাসন, নতুন অস্ত্র, নতুন ধর্ম, নতুন রীতি। সিল্ক রুট বা রেশম পথের ছোট্ট ছোট্ট জনপদ থেকে উৎসারিত সৈনিকগণ যুদ্ধ ও বর্বরতায় চিরকালের মতো বদলে দিয়েছিলেন বিশ্বের চেহারা।

সেই রেশম পথের উপান্তে, ককেসাসে প্রজ্জ্বলিত যুদ্ধের দাবানল মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের রক্তাপ্লূত অধ্যায়ের ফিরে আসাকে। আবার দেখায় হারিয়ে যাওয়া পুরনো রণাঙ্গনকে নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের অবয়বে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর