ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনা টিকা চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পায় এবং প্রথমবারের মতো প্রয়োগ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মডার্নার করোনাভাইরাসের টিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ফাইজার ও মডার্নার তৈরি করোনা টিকার বৈশিষ্ট্য অনেকটাই একইরকম। তবে কয়েকটি মূল পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে মডার্নার টিকাটির সংক্ষরণে অতিরিক্ত ঠান্ডার প্রয়োজন নেই। সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য আরও সহজলভ্য বলে সংস্থাটি দাবি করেছে।
শুক্রবারের (১৮ ডিসেম্বর) মধ্যে মডার্নার টিকা জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)। এর জন্য বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) এফডিএ’র টিকা উপদেষ্টা কমিটি বৈঠকও করেছে।
এখন চলুন জেনে নেওয়া যাক-মডার্নার করোনা টিকা সম্পর্কে এবং ফাইজারের টিকা থেকে এর আলাদা কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ফাইজারকে যুক্তরাষ্ট্রের জায়ান্ট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে মডার্না যার সংক্ষিপ্ত রূপ আরএনএ। এটি ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের কেমব্রিজ ভিত্তিক একটি বায়োটেক সংস্থা।
গত ৩ মার্চ মডার্নার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন দেয় এফডিএ। প্রথম ট্রায়াল হয় ২৭ মার্চ। মডার্না টিকাটিই যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সরকারি অর্থায়নে করোনা টিকা, যারা তিন ধাপে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। গত ৩০ নভেম্বর সংস্থাটি টিকাটির জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন চেয়ে এফডিএ-তে আবেদন করেছে।
পরীক্ষামূলক ট্রায়ালে মডার্নার টিকা করোনা প্রতিরোধে কার্যকর এবং সুরক্ষিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এফডিএ’র উপদেষ্টা কমিটির প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, মডার্নার টিকা করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকর। আর গুরুতর পর্যায়ের কোভিড আক্রান্ত হওয়া থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এটি শতভাগ সুরক্ষা দেয়। টিকাটি বিভিন্ন গোষ্ঠী, লিঙ্গ ও জাতির করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর। এর গবেষণায় স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ এবং ২০ ভাগ হিস্পানিক জনগোষ্ঠী ছিলো।
কীভাবে এটি কাজ করবে
ফাইজারের টিকার মতো, মডার্নার টিকা আরএনএ বা এমআরএনএ সরবরাহ করে। যা জেনেটিক কোডের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে শরীরকে শেখায় যে কিভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। একবার ইনজেকশন দেওয়ার পরে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। যদি কোন ব্যক্তি টিকা নেওয়ার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে অ্যান্টিবডি ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ শুরু করে।
বিশেষ করে মডার্নার এই টিকাটিতে কৃত্রিম এমআরএনএ রয়েছে যা ভাইরাসের ‘প্রিফিউশন স্ট্যাবিলাইজড স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন’ তৈরি করে। এছাড়াও এই টিকায় লিপিডস, ট্রমেটামাইন, ট্রমেটামাইন হাইড্রোক্লোরাইড, এসিটিক অ্যাসিড, সোডিয়াম অ্যাসিটেট এবং সুক্রোজ নামক ফ্যাটযুক্ত উপাদান রয়েছে।
মডার্নার টিকা কীভাবে ফাইজারের থেকে আলাদা?
এই দুইটি টিকাই একই ধরণের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব সেবা বিভাগের সচিব আলেক্স অজার বলেছেন, ফাইজার ও মডার্নার টিকার মধ্যে কয়েকটি মূল পার্থক্য রয়েছে। যা মডার্নার টিকাকে ‘আরও নমনীয়’ করেছে।
কার্যকারিতা: মডার্না ও ফাইজারের উভয়ের টিকা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৯৫ শতাংশ কার্যকর।
মঙ্গলবার সিএনএন-এর ‘নিউ ডে’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এফডিএ’র টিকা উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ড. পল অফিট বলেন, দু’টি টিকা মোটামুটি এক বৈশিষ্ট্যের বলে আমার মনে হয়।
গঠন: মডার্না ও ফাইজারের প্রস্তুতকৃত টিকাগুলো হলো এমআরএনএ টিকা। যদিও কিছুটা ভিন্ন কাঠামো রয়েছে। আর এজন্য পরিবহন ও সংরক্ষণ করার পার্থক্য রয়েছে।
সংরক্ষণ: সংরক্ষণের জন্য মডার্নার টিকা অনেকটা স্বস্তিদায়ক। এই টিকাটি ফাইজারের টিকার মতো উচ্চ মাত্রার ঠান্ডায় রাখতে হবে না।
ফাইজার আবিষ্কৃত টিকা সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মাত্র পাঁচদিন এই ভ্যাকসিন ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে।
অন্যদিকে মডার্নার টিকা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বাড়ির ফ্রিজেও এই টিকা রাখা যাবে। ৩০ দিন পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে এই টিকা স্থানান্তর ও ম্যানেজ করা সহজ।
এই দুই ভ্যাকসিনের তুলনা করলে দেখা যায়, ফাইজারের ভ্যাকসিনগুলি হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠিত অবকাঠামো ও বড় প্রতিষ্ঠানে বেশি ব্যবহৃত হবে। অন্যদিকে স্থানীয় চেইন বা ফার্মাসিস্টের মতো ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানেও মডার্নার টিকা ব্যবহার হবে।
ডোজ এবং সময়: মডার্নার ভ্যাকসিনটি ২৮ দিনের ব্যবধানে দু'বার ১০০ মাইক্রোগ্রাম করে ডোজ হিসাবে দেওয়া হয়। আর ফাইজারের ভ্যাকসিনের দুই ডোজ ২১ দিনের ব্যবধানে ৩০ মাইক্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়।
বয়স: অনুমোদিত হলে মডার্না ভ্যাকসিনটি ১৮ এবং তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে ব্যবহার করা হবে। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি ১৬ এবং তার বেশি বয়সীদের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মডার্নার টিকা কী নিরাপদ?
মডার্নার টিকার বিষয়ে এফডিএ বলেছে, এই টিকার ব্যবহারে নির্দিষ্ট কোনও সুরক্ষা উদ্বেগ নেই; যা টিকাটির জরুরি অনুমোদন পেতে বাধা দিতে পারে।
ভ্যাকসিনটি ব্যবহারে সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন- ক্লান্তি, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা এবং সর্দি দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে গুরুতর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিলো না।
কবে পাওয়া যাবে মডার্নার টিকা
স্বাস্থ্য ও মানব সেবা বিভাগ জানিয়েছে, আমেরিকা প্রথমে মডার্নার ভ্যাকসিনের ১০০ মিলিয়ন ডোজ কিনেছিল। গত সপ্তাহে আরও ১০০ মিলিয়ন ডোজ কিনতে রাজি হয়েছে। ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলাকালীন সময়ই মডার্না প্রথম ১০০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন শুরু করে।
'অপারেশন ওয়ার্প স্পিড'-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনসেফ স্লাউই আশা করছেন শুক্রবারেই মডার্নার টিকাটির জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন দেবে এফডিএ। যদি তা হয় তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা সরবরাহ করা হবে। যাতে করে আগামী সোমবার থেকে প্রয়োগ করা যায়।
সূত্র: সিএনএন