বছরব্যাপী বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক ও ভীতির মধ্যে ভ্যাকসিন বা টিকা আশা জাগিয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাছে পৃথিবীর মানুষকে। বাংলাদেশেও টিকাকরণের হার প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিদিনই কোটি কোটি মানুষ ভ্যাকসিন নিচ্ছেন।
করোনার তথ্য নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান 'আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা'র এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা অনুপাতে শতাংশের হারে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে ইসরায়েল। দেশটি ইতিমধ্যে তার ৬২ দশমিক ১ শতাংশ জনগণকে টিকা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে এই হার ১৬ দশমিক ৯, যুক্তরাষ্ট্রে ১১, স্পেনে ৪ দশমিক ৩, ইতালিতে ৪ , জার্মানিতে ৩ দশমিক ৭, বেলজিয়ামে ৩ দশমিক ৫, ফ্রান্সে ২ দশমিক ৯, কানাডায় ২ দশমিক ৮, নেদারল্যন্ডস ২ দশমিক ১, ব্রাজিল ১ দশমিক ৪, ভারতে দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে। প্রতিনিয়ত টিকাকরণের হার ও দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দিকের প্রয়োগকারী দেশগুলোর একটি হিসাবে টিকাকরণের নিরিখে দ্রুত সামনের কাতারে চলে আসছে। জনগণের সর্বস্তরে ক্রমে ক্রমে টিকা প্রদানের পরিধি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে টিকাদান কেন্দ্র। টিকা প্রদানের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রস্তুত হচ্ছে বেসরকারি সেক্টরও।
প্রথম ডোজ নেওয়ার (৭ ফেব্রুয়ারি) ১০ দিনে ভ্যাকসিনের উল্লেখযোগ্য কোনো মারাত্মক বিরূপ বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি বাংলাদেশে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও উল্লেখযোগ্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও মিডিয়ায় টিকা গ্রহণের পর ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন লোকজন। বিশিষ্টজন থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকার ফলে আস্থা, সাহস বেড়েছে। করোনাকালের করাল গ্রাস থেকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় শোনা গেছে টিকা গ্রহণকারীগণের মুখে।
করোনার বিরুদ্ধে টিকার প্রথম সুখবর দিয়েছিল রাশিয়া। সবার আগে মানব শরীরে করোনা ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল রুশ বিজ্ঞানীরা। সেই সাফল্যের পথ ধরে সব পরিকল্পনামাফিক রেজিস্টার হয় বিশ্বের প্রথম করোনা ভ্যাকসিনটি। রাশিয়ার তৈরি করোনা ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পুটনিক-৫।
তবে, পরবর্তীতে টিকার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর মধ্যে ফাইজার ও মডার্না আরএনএ প্রযুক্তির টিকা তৈরি করেছে। এ প্রযুক্তিতে এতে দ্রুত টিকা তৈরি করা সম্ভব। এতে ভাইরাসের জেনেটিক কোডের ক্ষুদ্র একটি অংশ দেহে প্রবেশ করানো হয়, যা শরীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ প্রযুক্তির টিকা যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পেয়েছে। অন্যদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাটি আলাদা। এতে নিরীহ ভাইরাস ব্যবহার করে শরীরে জেনেটিক উপাদান প্রবেশ করানো হয়। এ টিকাটি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে অনুমোদন পেয়েছে।মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের তুলনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ ও পরিবহন সহজ।
বঙ্গভ্যাক্স নামে কোভিডের টিকা তৈরি করছে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান।
ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই চীনের।করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে অন্যতম সফল মানা হচ্ছে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেককে। অক্সফোর্ডের টিকাটি ভারতে তৈরি করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। এটি ছাড়াও ভারতের নিজস্ব টিকা কোভ্যাক্সিন এবং ফাইজারের টিকাও।
জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিরাপদ ও কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তাদের এমআরএনএভিত্তিক প্ল্যাটফরমে কাজ করেছে। তবে পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে আরো ১৭১টি টিকা। টিকার নিরাপত্তা নিয়ে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ১৯টি, বিস্তৃত পরিসরে পরীক্ষার পর্যায়ে আছে ২৫টি এবং ব্যাপক আকারে পরীক্ষার পর কার্যকারিতা মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে আরো ২১টি টিকা।
করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের জয়জয়কার ও বিশ্ববাসীর ঘুরে দাঁড়ানোর আশার মধ্যে হতাশার খবরও রয়েছে। করোনা ভাইরাসের 'নতুন ধরন' উদ্বেগ বাড়িয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। ব্রিটেন যে কারণে প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে। তদুপরি বিশ্বের শীর্ষ করোনা আক্রান্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বিরূপ খবর পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে করোনা ভাইরাসের নতুন ৭টি ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তা অধিক পরিমাণ সংক্রামক কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা না হলেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি হেলথ সায়েন্সেস সেন্টার শ্রেভেপোর্ট-এর ভাইরোলজিস্ট জেরেমি কামিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে, এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। নতুন এই গবেষণার সহ-লেখক তিনি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন সায়েন্স এলার্ট। এতে বলা হয়েছে জেরেমি কামিল বলেছেন, তিনি এই করোনা ভাইরাসের নমুনা নিয়ে এর সিকুয়েন্সিং করার সময় নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখতে পান। এগুলো একই অ্যামাইনো এসিডে রূপান্তরিত হয়েছে।
করোনার বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে সূচিত ভ্যাকসিন যুগ আশার সঞ্চার করলেও বিপদ পুরোপুরি কেটে যাচ্ছে না। ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য এর গতি, প্রকৃতি ও রূপান্তরের বিষয়ে বিজ্ঞানীদের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হচ্ছে। তৈরি হতে হচ্ছে ভাইরাসের বিরূপ আচরণ ও পরিবর্তিত রূপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যেও। ভ্যাকসিনকেও সেভাবে পুনর্গঠিত করতে হচ্ছে এবং করোনা পরিস্থিতির পরিপূর্ণ অবসানের পূর্ব-পর্যন্ত মাস্ক ও সেনিটাইজার ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব পালন এবং প্রয়োজনে সঙ্গরোধের মতো বিষয়গুলো সঠিকভাবে প্রতিপালন করে যেতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা।