নজরুল স্মৃতিধন্য ডি.এম.লাইব্রেরি

ভারত, আন্তর্জাতিক

সোমঋতা মল্লিক | 2023-09-01 15:24:57

‘বুলবুলের মৃত্যুর সময় আমি কলিকাতা ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া কবি-গৃহে কবির অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, কবি ডি.এম.লাইব্রেরিতে গিয়াছেন। আমি সেখানে গিয়া দেখিতে পাইলাম, কবি এককোণে বসিয়া হাস্যরসপ্রধান ‘চন্দুবিন্দু’ নামক কাব্যের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। পুত্রশোক ভুলিবার এই অভিনব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, কবির সমস্ত অঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দুটি কাঁদিতে-কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। কবি দু -একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। এখনও আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারিনা, কোন্ শক্তি বলে কবি পুত্রশোকাতুর মনকে এমন অপূর্ব হাস্যরসে রূপান্তরিত কবিয়াছিলেন! কবিতা লিখিবার স্থানটিও আশ্চর্য্যজনক। যাঁহারা তখনকার দিনে ডি.এম.লাইব্রেরির স্বল্প পরিসর স্থানটি দেখিয়াছেন, তাঁহারা অবস্থা অনুমান করিতে পারিবেন। দোকানে অনবরত কেনা-বেচা হইতেছে, বাহিরের হট্টগোল-কোলাহল-তার এক কোণে বসিয়া কবি রচনা-কার্যে রত।’

প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলের মুত্যুর পর কাজী নজরুল ইসলামের মানসিক অবস্থার বর্ণনা এভাবেই করেছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। তাঁর এই স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ডি.এম.লাইব্রেরির নাম। বর্তমান ঠিকানা- ৪২ বিধান সরণি, কলকাতা-৭০০০০৬।

কলকাতার বই প্রেমীদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ ‘গোপাল দা’ - গোপালদাস মজুমদার মহাশয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ডি. এম. লাইব্রেরির প্রথম বই প্রকাশিত হয়। বইটি বিপ্লবী বারীণ কুমার ঘোষের আত্মকাহিনী। এরও কয়েকবছর আগে শ্রী অরবিন্দের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে 'বিজলী' পত্রিকার দপ্তরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ডি. এম. লাইব্রেরির। মুখ্যত আর্য পাবলিশিং প্রকাশিত শ্রী অরবিন্দ ও অন্যান্য বিপ্লবীদের বই ও পুস্তিকার প্রচার ও বিক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড। গোপালদাস মজুমদার মহাশয় প্রয়াত হন ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুন তারিখে। গোপালদার স্মরণসভায় বিশিষ্ট সাহিত্যসেবীরা তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঐদিন 'স্মরণে' নামে একটি ছোট্ট পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। ঐ পুস্তিকাতে অন্নদাশঙ্কর রায়, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, সমরেশ বসু,আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী প্রমুখ প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন লেখার মাধ্যমে।

রমাপদ চৌধুরী মহাশয় 'আমাদের গোপল দা' শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেন- "তিনি শুধু প্রকাশক ছিলেন না, রাজসাক্ষী নরেণ গোঁসাই বলেছিলেন, জ্যোতিষ মজুমদারের কাছেই বড়লাটকে মারার বোমা ছিল। এই মেজদার সুবাদেই তিনি বিপ্লবীদের দলে এসেছিলেন। ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন শ্রী অরবিন্দ এবং বোমারু বারীণ ঘোষের সঙ্গে। দৌলতপুর কলেজের হোস্টেলে তাঁর কাছে এসে রাত কাটিয়ে যেতেন বাঘা যতীন। সেইসব দিনের খুঁটিনাটি কথা, দৈনন্দিন জীবনের টুকরো-টুকরো ঘটনা, যখন তিনি কৌতুকের স্বরে রসিয়ে রসিয়ে বলতেন-তন্ময় হয়ে শুনতে হত। আর গল্প শেষ করে যখন উপসংহার টানতেন, দেখতে পেতাম তাঁর কি গভীর শ্রদ্ধা ঐ মানুষগুলির উপর।

'বারীণ ঘোষের আত্মকথা' প্রথম বই হলেও রাজনীতি তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। সাহিত্য তার আপন আঙিনায় তাঁকে টেনে নিল। সুখে, আনন্দে, আপদে-বিপদে কবি, ঔপোন্যাসিক, প্রবন্ধকার সকলের সবচেয় অন্তরঙ্গ বন্ধু। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দিনের পর দিন একত্রে থেকেছেন, অভাবের দিনে এক অন্ন দু - ভাগ করে খেয়েছেন, তাঁর বিলাস ব্যসনে বাধা দিতে না পেরে শেষে যথাসাধ্য অর্থ জুগিয়েছেন।

জীবনানন্দ আজ বিখ্যাত, তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে,যথেষ্ট স্বীকৃতি পাওয়ার পর। কিন্তু শুরুতেই জীবনানন্দের প্রথম বই বের করেছিলেন এই গোপাল দা। প্রমথ চৌধুরীর বহু রচনার তিনি ছিলেন প্রথম শ্রোতা। নজরুলের অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী এবং উপেন বাড়ুজ্জে, এম. এন. রায়ের বই ছাপার ফলে স্টেটসম্যানে প্রকাশক সম্পর্কে সাবধান বাণী বের হয়েছিল। কিন্তু গোপাল দা দমেননি। বিপ্লবী থেকে প্রকাশকে রূপান্তর ঘটলেও রাজনৈতিক বই বের করার মধ্যে সেই 'বিদ্রোহী' ভাবটা রয়েই গিয়েছিল। পরমানু বিজ্ঞানের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বাংলা বইটি তিনিই বের করেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তখন কল্লোল যুগের লেখকরা অভিজাত প্রকাশকদের কাছে অস্পৃশ্য ছিলেন। গোপালদা তাঁদের দিয়েছিলেন সৌহার্দ্যের আশ্রয়। যে বিশ্বাস রেখেছেন, কিংবা গোপালদা যাকে বিশ্বাস করেছেন তাঁকে শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করে গেছেন। শুধু লেখকদের ক্ষেত্রেই নয়, অন্তত এক ডজন প্রেস তাঁরই টাকায় গড়ে উঠেছিল। অসংখ্য দপ্তরিখানাও।একটা সামান্য দেওয়ালের দোকান থেকে ৬১ নম্বর কর্নওয়ালি স্ট্রিট, সেখান থেকে এই ৪২ নম্বরে আসার এবং স্থিতির ইতিহাস শুধু একজন প্রকাশকের ইতিহাস নয়। অর্ধ-শতাব্দীর বাংলার রাজনীতির, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাসের সঙ্গে তা জড়িয়ে আছে।"

গোপালদাস মজুমদার তাঁর 'স্মরণ-বরণ' গ্রন্থে লিখেছেন- ‘‘একদিন 'বিজলী' অফিস ফাঁকা, আমি একা আছি। সন্ধ্যের কাছাকাছি একখানি বড় মোটরগাড়ী এসে থামল বৌবাজার বিজলী অফিসের দরজার সামনে। দেখলাম গাড়ী থেকে যিনি নামলেন এবং সোজা 'বিজলী' অফিসে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন তাঁর চেহারার মধ্যে এক অপূর্ব জ্যোতির প্রভাব। মাথায় পারস্য টুপি, পরিধানে সিল্কের ঢলঢলে পাজামা এবং পাঞ্জাবী। সুমধুর কণ্ঠস্বর। খোঁজ করলেন নলিনীদার। তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসিয়ে বললাম, 'ললিনীদা তো নেই, বারীণদাও নেই।' কবি জিজ্ঞেস করলেন শচীন সেনগুপ্তের কথা। 'না, তিনিও বেরিয়েছেন, আমি একাই আছি।' কবি আত্মপরিচয় দেওয়ার আগেই অনুমানে তাঁকে চিনেছিলাম, এইবার তাঁর নিজের মুখে পরিচয় শুনে শ্রদ্ধা ভরে প্রণাম জানালাম। আবেশে আমার মুখ দিয়ে কথা বার হচ্ছিল না। বিশ্ববন্দিত মহাকবি আজ প্রত্যক্ষ ভাবে স্ব-শরীরে আমার সামনে উপস্থিত। তিনি আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। সবিনয়ে আত্মপরিচয় দিলাম। বললাম, 'আপনার কোনো কাজে লাগলে নিজেকে ধন্য মনে করব।' কবি বললেন, 'আমার বাদল-বাউল প্রকাশিত হয়েছে বিজলীতে। এক সংখ্যা বিজলী নিতে এসেছি।' ছুটে ভেতরে গেলাম বিজলী পত্রিকা আনতে। কবির হাতে তা তুলে দিতে কবি প্রীত হলেন।"

কবিগুরুর সাথে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন গোপাল দাস মজুমদার। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন - "কেমন করে না জানি নজরুলের অন্তঃসান্নিধ্য লাভ করেছিলাম বিজলীতে থাকার কালেই। তাঁর জাগ্রত ও উদ্দীপনাময় কবিতা আমাকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। আমার রাজনৈতিক চেতনাকে বলদৃপ্ত করেছিল। আমার মনে হয়েছিল কবি প্রকৃতই কাণ্ডারী। তিনি স্বয়ং ঈশ্বর প্রেরিত, ঐশ্বরিক কাব্যশক্তি লাভ করে পরাধীন দেশে জন্মেছেন পরশাসনে পীড়িতা জন্মভূমির বন্ধন-শৃঙ্খল ঘোচাতে। জীবনে বহু কবি –সাহিত্যিকের সংস্পর্শে এসেছি, কিন্তু নজরুল প্রতিভার, নজরুল বৈশিষ্ট্যের আর কে এমন আছেন যিনি কম্বু কণ্ঠে নিদ্রিত দেশবাসীকে জাগরণের মন্ত্র শুনিয়েছেন? যাঁরা লেখাপড়া শিখে অনুশীলন করে পরিমার্জিত লেখা লেখেন, তাঁরা বরেণ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু নজরুল স্বতন্ত্র। রবীন্দ্র আকাশের তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।ধুমকেতুর মধ্যে সেই অগ্নিময় জ্যোতিষ্কের সন্ধান পেলাম। আর সেই আগুনের পরশমনি ছুঁয়ে জীবনকে ধন্য এবং পুণ্যময় বলে অনুভব করতে লাগলাম। নজরুলকে একথা বলায় আমাকে গভীর অন্তর ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন- গোপালদা, এতো ভালোবাস তুমি আমায়? শুধু কি ভালোবাসা? আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বিদ্রোহী কবি প্রেমিক কণ্ঠে বলেছিলেন- হ্যাঁ, শুধুই ভালোবাসা। প্রেম। প্রেমের তুল্য অন্তরনিষ্ঠ সম্পদ আর কিছু নেই। শ্রদ্ধা অনেক দূরের বস্তু। আমি বলেছিলাম, তবে তাই।"

ডি. এম. লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের বেশ কিছু বই। সেই প্রসঙ্গে গোপালদা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন- "নজরুল এলেন তাঁর অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশী নিয়ে। বিষের বাঁশী প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ সরকার কর্তৃক তা বাজেয়াপ্ত করা হল। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল লালবাজার থানায়। একরাত্রি হাজতবাস সেখানে। সব বই দোকান থেকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। ডি. এম. লাইব্রেরি র কর্ণওয়ালি স্ট্রিটের ছোট্ট দোকান ঘরখানির সামনে মোতায়েন হল ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা। কিন্তু একরাত্রি হাজতবাসের দুর্ভোগ এবং দোকানস্থিত সব বই খোয়া গেলেও সাপে বর হল। দপ্তরিখানায় কিছু বিষের বাঁশী বাঁধাবার জন্য পড়েছিল। পুলিশ তার সন্ধান পায়নি। ঝড়ের হাওয়ায় গোপনরক্ষিত সেই বইয়ের সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গেল। আমার প্রকাশনায় অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশী ছাড়াও অন্যান্য সব কবিতা ও গানের বই, উপন্যাস প্রভৃতি প্রকাশ হতে লাগল। নজরুল আমাকে ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশককে বই প্রকাশের জন্য দিতেও চাইতেন না। নজরুলের কবি-চিত্ত ঝোড়ো হাওয়ার সামিল। যা কিছু রোজগার করতেন তা ব্যয় করতে কার্পন্য ছিলনা তাঁর। বিয়ে করে সংসার, জীবন-যাত্রা ব্যয়-নির্বাহের ভাবনা-চিন্তার লেশমাত্র ছিল না স্বভাবে। অদ্যভক্ষ ধনুর্গুণঃ এই ছিল তাঁর চরিত্রের প্রকৃতি।নজরুলের সঙ্গে আইনগত লেখক এবং প্রকাশকের চুক্তিপত্র থাকলেও অপর এক হৃদয়গত সম্পর্ক ছিল যাকে বলা যায় আত্মীয়তার বন্ধন। আজ পুস্তক বিপনী ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের অনুগ্রহে ডি. এম. লাইব্রেরি সমৃদ্ধ, কিন্তু যখন মাসিক ১২ টাকা ভাড়ার কর্ণওয়ালি স্ট্রীটের ছোট ঘরখানির সামনে অভুক্ত দারিদ্র পীড়িত এক পুস্তক ব্যবসায়ী রাস্তার উপর টুল পেতে বসে জীবনের সঙ্গে কঠিন সংগ্রামরত, তখন তার দিনান্তের বই বিক্রির রোজগারের মাত্র ১০টাকা থেকে হাসিমুখে কবিকে ৫টি টাকা দিতে কোনো বেদনা বোধ হয়নি। কবি এবং কবি - জায়া সে কথা কোনদিন ভোলেনি। তাই বাহ্য জ্ঞান হারা কবি নজরুল যখন অক্ষম, রোগশয্যায় শায়িত তখন নানা প্রলোভনের ব্যবসায়ী চুক্তিকেও অগ্রাহ্য করে প্রমীলা আমার সংস্থার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবকে বলেছেন, না গোপালদা থাকতে আর কাউকে বই দেবনা। ওসব বই গোপালদারই।"

নজরুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় বই সঞ্চিতার প্রকাশক ডি. এম. লাইব্রেরি।এই সঞ্চিতার নির্মাণ সম্পর্কে গোপালদা তাঁর অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন 'স্মরণ-বরণ' গ্রন্থে - "পুস্তক ব্যবসায়ী স্বর্গত ব্রজবিহারী বর্মণ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের (বর্তমানে যার নাম বিধান সরণী) তাঁর প্রকাশনী বর্মণ পাবলিশিং থেকে যখন নজরুলের কাব্য ও গীতি সংকলন সঞ্চিতা প্রকাশ করলেন সেই ক্ষুদ্রায়তনের সংকলন খানি দেখে আমি ব্যথিত হলাম। বইখানির দাম ছিল দেড়টাকা। অল্পসংখ্যক কবিতা এবং গান তাতে সংকলিত হয়েছিল মাত্র। এই বই দেখে নজরুলও খুশি হননি। কবিগুরুর সঞ্চয়িতা প্রকাশিত হয়েছে। আমি নজরুলের কাছে প্রস্তাব জানালাম নজরুলের অধিক সংখ্যক কবিতা এবং গান নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুস্তিকা প্রকাশিত হোক সঞ্চিতা নাম দিয়েই। খুশি মনেই নজরুল তাঁর স্বীকৃতি জানালেন। অতঃপর আমি প্রকাশ করলাম সঞ্চিতা। সেই সঞ্চিতা আজ কবিগুরুর সঞ্চয়িতার মতনই বাঙালি পাঠকের ঘরে সমাদৃত। সঞ্চিতার কবিতা এবং গানগুলি কবি নিজেই নির্বাচন করলেন। প্রথম সেই বই ছাপা হল স্বর্গত সজনীকান্ত দাসের আনুকূল্যে প্রবাসী প্রেসে। সজনীকান্ত দাস তখন প্রবাসী প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন। বন্ধুবর সজনীকান্ত দাসের সাহায্য এবং সৌজন্যকে কৃতজ্ঞতার সহিত স্বীকার করি।"

শুধুমাত্র সঞ্চিতা নয়, ডি.এম. লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের বেশ কিছু বই। এই বইগুলো সেই সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই প্রসঙ্গে গোপাল দাস মজুমদার লেখেন - "নজরুলের বই এর চাহিদা বেড়েছে। তাঁর কবিতা সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাঁর গানে বাজার ছেয়ে গেছে। ডি.এম. থেকে নজরুলের বই বেরল মৃত্যুক্ষুধা,বাঁধনহারা, কুহেলীকা। নজরুলের নতুন বই বেরুলেই বাজারে সাড়া পড়ে যেত। বই-এর বাজারে ঝড় তুলেছেন একদিকে শরৎচন্দ্র,আর একদিকে কাজী নজরুল ইসলাম। শুধু কি কবিতা? নজরুল রচিত গদ্য-পদ্য নানা ধরনের বই প্রকাশনার সুযোগ লাভ করেছি আমি। নজরুলের নাটকও আমার সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়। গল্পের বই-এর মধ্যে মনে পড়ে রিক্তের বেদন আর শিউলিমালার কথা। প্রবন্ধের বই দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্রমঙ্গল এবং রাজবন্দীর জবানবন্দী ঝড় তুলেছিল। পরলোকগত মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সম্পাদিত পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের সাম্যবাদী প্রকাশ করলাম আমি আর নাট্যকার মন্মথ রায় লিখিত 'মহুয়া' নাটকের অন্তর্গত নজরুলের নখানি গান মাত্র দুআনা দামের সিরিজের বইরূপে।কি অসম্ভব বিক্রি এই ছোট্ট দুখানি পুস্তিকার। বিন্দু থেকে সিন্ধু লাভ হল আমার। ডি.এম.লাইব্রেরি প্রকাশিত নজরুলের কবিতা, গানের বহু বই প্রকাশ করে আমি ধন্য হয়েছি। তখনকার দিনে বাইশ শ করে ছাপা বই এক বছরের মধ্যে ফোর্থ এডিশন হওয়া দুঃস্বপ্নের কথা। নজরুলের ‘বুলবুল’ কিন্তু তাই হয়েছিল। দাম পাঁচ সিকা। পাঁচ সিকা থেকে কত সিকে যে লাভবান হয়েছি তা ঈশ্বরের অনুগ্রহ, নজরুলের বন্ধুপ্রীতি এবং আমার সৌভাগ্যের নিদর্শন।"

নজরুলের গানের স্বরলিপিও প্রকাশ করে ডি.এম.লাইব্রেরি। গান নিয়ে আলোচনা আর স্বরলিপি বই প্রকাশের কথা পুস্তক-প্রকাশকরা তখনকার দিনে ভাবতেই পারতেন না। গোপালদা ছিলেন এ বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী। তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন-"বিষ্ণুপুরের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়ক স্বর্গত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ ব্যয়ে দু-একখানি সঙ্গীতের পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন বটে, রবীন্দ্র সঙ্গীতের স্বরলিপিও কিছু কিছু প্রকাশ হতে থাকে, কিন্তু তাতে ব্যবসায়িক পুস্তক বিক্রেতা এবং প্রকাশকের দল সঙ্গীত বিষয়ক পুস্তকাদি প্রকাশে উৎসাহিত হননি। আমার আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। নিজে গান জানতাম না কিন্তু গানের প্রতি আমার অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই। নজরুলের অনেকগুলি গানের স্বরলিপি পুস্তক আমি ছাপি-নজরুল স্বরলিপি, সুরমুকুর, সুরলিপি, নজরুল সুরসঞ্চয়ন প্রথম,দ্বিতীয় এবং তৃতীয়ভাগ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।"

বাংলা নাটক প্রকাশ করতেও তিনি ছিলেন সমানভাবে আগ্রহী - "আমি ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন নাটক, জীবনীমূলক, হাসি এবং ব্যঙ্গ রসাত্মক গীতি নাট্য প্রভৃতি নানা ধরনের নাটক প্রকাশ করি। কাজী নজরুল ইসলাম, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, ভূপেনন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, প্রমথনাথ বিশী, যোগেশ চৌধুরী, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়,ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, মন্মথ চৌধুরী ও অজয় দাশগুপ্ত প্রভৃতি নাট্যকারের নাটকও প্রকাশ করেছি।"

গোপালদাস মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় নজরুলকে ‘পরম সুহৃদ- আমার পরমপ্রিয় অনুজতুল্য' বলে উল্লেখ করেছেন। নজরুলের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সম্পর্ক। বিভিন্ন সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের নানান আবদার মিটিয়েছেন বহু অসুবিধে সত্ত্বেও। নজরুলের বিলিতি ক্রাইসলার গাড়ি সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- "কবির তখন একান্ত দরকার হয়ে পড়ল একখানি মোটরকারের। নজরুল বললেন, 'গোপালদা যে করে পার গাড়ি একখানি আনাও, তাছাড়া ইজ্জত থাকে না।' নাছোড়বান্দা নজরুল। মোটরকার ছাড়া আমার প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখা যাবে না। অতএব ধারের উপর ধার।

নানা বন্ধুজনের সহায়তায় তখনকার দিনে এগার হাজার টাকা দামে বিলিতি ক্রাইসলার কেনা হল নজরুলকে উপহার দেওয়ার জন্য। নজরুল কথা রেখেছিলেন। তিনি ডি.এম. লাইব্রেরি র একান্ত আপনজন হয়েছিলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ডি.এমেই কাটিয়ে আস্তানায় ফিরেছেন। তাঁর সঙ্গে ব্যবসাগত সম্পর্ক যে আমার নয় সে কথা প্রমীলাও বুঝতেন। প্রমীলাও আমাকে দাদা বলেই সম্বোধন করতেন আর বলতেন, গোপালদা আমাদের জন্যে যা করেছেন সে কথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার স্বামীর বই আমার জীবিত কালে আপনিই বিক্রি করবেন।’’

শুধুমাত্র কবিপত্নী প্রমীলার জীবদ্দশায় নয়, এখনও ডি.এম. লাইব্রেরির পুুস্তক তালিকায় সর্বাগ্রে চোখে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের বই। চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয় বিদ্রোহী কবির বহুবিধ সত্ত্বাকে -

'দশদিগন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যে একমাত্র সৃষ্টিশীল যুবরাজ,

যাঁর কবিতার আয়োজন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অন্তরঙ্গ দর্পণ

এবং বিশাল সীমাহীনতায় মোহনীয় রূপারোপ।

অথচ 'বিদ্রোহী'- এই একটিমাত্র তিলকে ভূষিত করবার উচ্ছ্বাস

তিন দশকের শুরু থেকে উচ্চারিত হলেও,

তিনি প্রথম বাস্তববাদী কবি,বাংলা কবিতায়।

আর-

প্রেমে ও প্রজ্ঞায়,

বুদ্ধি ও মেধায়,

লাবণ্যে ও সরলতায়,

ছন্দে ও শব্দে,

বিষয় ও প্রতিভায়,

এই নিঃসঙ্গ যুবরাজ

সপ্তসিন্ধু প্রেক্ষাপটে,

নিবিড়তর সম্বন্ধে পাঠককূলের নিত্য-বান্ধব।

তাই 'বিদ্রোহী' ও 'উন্মাদ'

মনস্বিতায় লীন হয়ে গেলেও কিংবদন্তীর নয়,

আজকের সামাজিক,

বাস্তববাদী

নজরুল ইসলাম

বহুর সংমিশ্রণে-

একক, সমকালীন, ধ্রুপদ।'

প্রকাশনার শতবর্ষে পদার্পন করল ডি.এম. লাইব্রেরি। এই বিশেষ বছরে কাজী নজরুল ইসলামের বহু পুস্তকের প্রকাশক হিসেবে নজরুল অনুরাগীদের পক্ষ থেকে রইল অনেক শুভেচ্ছা। নজরুলের সৃষ্টিকর্মকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক-এই প্রত্যাশা।

লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

তথ্য ঋণ: ১.স্মরণ-বরণ,গোপালদাস মজুমদার

২.পুস্তক-তালিকা,প্রকাশকঃ ডি.এম লাইব্রেরি

৩.সমকালে নজরুল ইসলাম,মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

এ সম্পর্কিত আরও খবর