তেলসমৃদ্ধ কিরকুক গরিব হওয়ার কারণ

মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 15:19:03

ইরাকের তেলসমৃদ্ধ একটি শহর কিরকুক। ইরবিল থেকে কিরকুক যাওয়ার পথেই তেলের গন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি শহরে পৌঁছার পূর্বেই তেলের গন্ধ নাকে আসে। চোখে পড়ে মহাসড়কের উভয় পাশের তেল শৌধনাগারের সাদা চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া। কুর্দিশ আধা-স্বায়ত্বশাসিত এলাকা থেকে কিরকুককে আলাদাকারী চেকপোস্টে তেলবাহী ট্রাকগুলোর সারি চোখে পড়ে।

সম্প্রতি আল-জাজিরার সাংবাদিক মারিয়া পেকোভার একটি প্রতিবেদনে কিরকুকের এ অবস্থা তুলে ধরা হয়। মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর স্বার্থপরতাই কিরকুকবাসীর গরিব হওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়।

কিরকুকের রাস্তার ধারে ছোট সবজি দোকানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পেট্রোল স্টেশন ও ছোট দোকানে প্রাস্টিকের পাত্রে বিক্রি হচ্ছে পেট্রোল।

শহরে প্রবেশ করতেই কিরকুকের রাজনীতির জটিলতা পরিষ্কার হয়ে যায়। কুর্দির ঐতিহ্যবাহী পোশাকে একজন পেশমের্গা যোদ্ধার ভাস্কর্য চোখে পড়ে, যার উপর ইরাকের পতাকা উড়ছে।

২০১৭ সালে যখন ভাস্কর্যটি উন্মোচন করা হয়, তখন এটি কেআরজি’র পতাকা ধারণ করেছিল, যাতে লাল, সাদা, সবুজ ও মাঝে একটি সূর্য। কুর্দিশ অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে কিরকুক জাতি হিসেবে দাবি করা কেআরজি আড়াই বছর আগে পেশমের্গা বাহিনীকে বিতাড়িত করে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্যা লেভান্ত (আইএসআইএল)-এর দখল থেকে রক্ষা করতেই তারা এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।

২০১৭ সালের অক্টোবরে ইরবিলের স্বাধীনতার দাবিতে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যা বাগদাদ ও তার মিত্রদের ক্ষিপ্ত করে। ইরাকের সন্ত্রাসদমন বাহিনী ও শিয়া পিএমইউ শহরটির দখল নেয় এবং ভাস্কর্যটিতে ইরাকি পতাকা স্থাপন করে।

বর্তমানে বাগদাদ, কেআরজি ও স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিবাদের মূল কারণ এ কিরকুক ও সেখানকার তেল। এ অবস্থা প্রাদেশিক প্রশাসনকে অকেজো করে রেখেছে, স্থানীয় অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করেছে এবং স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।

তেলসমৃদ্ধ কিরকুকে

কিরকুকের দখল নেওয়ার এক বছর পরে কুর্দিশ স্বাধীনতা গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাগদাদ। তারা পূর্বের সম্পদের হতাশাজনক অব্যবস্থাপনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

কিরকুকে ইরাকের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল রিজার্ব যা প্রায় ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ব্যারেল রয়েছে। কিন্তু এলাকাটির অধিবাসীরা অভিযোগ করেন যে, এ তেল সম্পদকে তাদের শহরের অবকাঠামো, সেবা ও স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নের জন্য ব্যবহার চোখে পড়ে না।

কিরকুকের ছোট মুদি দোকানের মালিক ৭৩ বছরের ফাহিমা আবু বাকির অক্টোবরের এক বিকালে বলেন, ‘সকাল থেকে আমাদের এখানে বিদ্যুৎ নেই।’ এ শহরে সব সময় বিদ্যুতের সমস্যা ছিল কিন্তু সাম্প্রতিক এ সমস্যা আরও খারাপ আকার ধারণ করেছে।

এ দোকানি বলেন, ‘আমি আমার দোকানে পণ্য জমা করতে পারি না। চেক পয়েন্টগুলোর কারণে দাম অনেক বেড়ে গেছে।’

বাগদাদ শহরটির দখল নেওয়ার পরে এর বাহিনী ইরবিল ও কেআরজি’র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বড় শহর সোলাইমানিয়ার পথে মহাসড়কে চেক পয়েন্টগুলো স্থাপন করেছে। কিরকুকে প্রবেশ করা অবৈধ পণ্যগুলোর উপর কর আদায় করার জন্য এ চেক পয়েন্টগুলো। কিরকুক ও এর প্রধান পরিবহণ কেন্দ্রে পণ্য আমদানির জন্য মহাসড়ক দুটিই ভরসা।

আবু বাকিরের দোকানের বাইরে অ্যালান নেজমেদ্দিন আব্দুল্লাহর (২৭) মুখেও একই অভিযোগ, একই সমস্যা।

ময়লা সংগ্রহসহ কয়েকটি মৌলিক সেবার অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তীব্র গরমে আমরা দৈনিক ১০ ঘণ্টারও কম সময় বিদ্যুৎ পাই।’

জাতিগতভাবে কুর্দি যুবক আব্দুল্লাহ কেআরজি শাসনামলে এ এলাকার পরিস্থিতি নিয়েও সন্তোষ্ট ছিলেন না। সাবেক কুর্দিশ গভর্নর ও প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তানের (পিইউকে) সদস্য নাজমিদ্দিন করিমকে সরিয়ে একজন আরবি রাকান আল-জাবোরিকে ক্ষমতায় বসায় বাগদাদ।

আব্দুল্লাহ বলেন, ‘প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো এমন লোকজন দিয়ে পূরণ করা হয় যারা এ শহরের নন। সাবেক কুর্দিশ গভর্নর কিরকুকের বাসিন্দা কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি দীর্ঘ সময় এখানে বাস করতেন না।’

‘আমি এমন একজন গভর্নর চাই, যিনি এখানে বাস করেন, মানুষের দুর্ভোগ জানেন এবং সকল গোষ্ঠী- কুর্দি, তুর্কি ও আরবদের সেবা করবেন।’

কুর্দিশ সাংবাদিক জানিয়ার জুমাও বলছেন যে প্রাদেশিক সভায় সংখ্যাগরিষ্ট কুর্দি দল যা ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, তারাও কিরকুকবাসীর ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তেমন কিছু করেনি।

জুমা বলেন, ‘এখানের সকল রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থের পেছনে ছুটছেন এবং এ শহরের অর্থ ও তেল চুরির চেষ্টা করছেন।’

তিনি শহরটিতে সামরিক শাসনেরও বিরোধিতা করেন। জুমা বলেন, ‘যদিও একজন বেসামরিক লোককে গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখানকার সন্ত্রাস দমন বাহিনী মূল দায়িত্ব পালন করেন।

জুমার ভাই আদহাম, একজন স্বাধীন কর্মী, অক্টোবরের প্রথমদিকে বেসামরিক বিষয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে জুমা বলেন, ‘রাত দেড়টার দিকে সন্ত্রাস দমন বাহিনীর সদস্যরা আদহামকে গ্রেফতারের জন্য বাড়িতে আসে। এ ধরণের সমস্যা করিমের শাসনের সময়ও ছিল। আমাকে পুলিশ স্টেশনে ডাকা হয়েছিল কিন্তু সেটি ইরাকি আইন অনুযায়ীই হয়েছিল। এখন সকল ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে এবং তারা প্রকাশ্যেই যা ইচ্ছা তা করে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর