ইন্দিরা গান্ধীর অন্তিম দিন

ভারত, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 08:12:26

৩৪ বছর আগের একটি দিন। ৩১ অক্টোবর। ১৯৮৪ সাল। স্থান নয়া দিল্লির ১ নম্বর আকবর রোড।। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন।

বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে হাঁটছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি যখন সতবন্ত সিং ও বেয়ন্ত সিংয়ের প্রহরাধীনে উইকেট গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন তারা তার ওপর গুলি ছোড়েন। সাব-ইন্সপেক্টর বেয়ন্ত সিং সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন ইন্দিরা গান্ধীর তলপেটে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সতবন্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়েই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন।

বেয়ন্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতবন্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০-এর দশকে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার শিখকে আটক করে কারাগারে রাখা হয়। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র শিখেরা মাঝেমধ্যেই সন্ত্রাসী হামলা চালাত। ভারতীয় সরকারের কাছে এরা ছিল সন্ত্রাসী।

১৯৮৪ সালের জুনে ইন্দিরা গান্ধী আদেশ দেন শিখদের স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালিয়ে এই মন্দিরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী-মুক্ত করতে। কারণ বলা হচ্ছিল, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখেরা স্বর্ণমন্দিরে অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে। এই সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। এরই জেরে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রাণ হারাতে হয়। ওই বছর শিখবিরোধী দাঙ্গা চলে ভারতে। শিখ ধর্মাবলম্বী দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর এর প্রতিক্রিয়ায় এ দাঙ্গা বাধে। এক হিসাবে এ দাঙ্গায় ৮ হাজারের মতো লোক নিহত হয়। শুধু দিল্লিতেই নিহত হয় ৩ হাজার। দাঙ্গা চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত।

ভারতের প্রথম ও এখন পযন্ত একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। বেড়ে ওঠা ও ধ্যান-ধারণার গঠনও রাজনীতিকেন্দ্রিক। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পিতা জওহরলাল নেহেরুর রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে তিনি ধরে রেখেছিলেন। হয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রীও। তার পুত্রও দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। এমন নজির বিশ্বে বিরল। তার পুত্রবধু ও নাতি দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ইন্দিরা শুধু একজন ব্যক্তি নন, তারচেয়েও বেশি।

রাজনীতি, প্রেম, ব্যক্তিগত বেদনা, সন্তান বিয়োগের শোক সয়েও তিনি শক্ত হাতে দেশ ও দলের হাল ধরে রেখেছিলেন। আবেগহীন লৌহকঠিন ব্যক্তিত্বের প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো করে সাধারণ চিন্তার ফুরসত ছিল না ইন্দিরা গান্ধীর। তবে হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লিখে গেছেন বেশকিছু গ্রন্থ। ‘দ্য ইয়ার্স অফ চ্যালেঞ্জ’ (১৯৬৬-৬৯), ‘দ্য ইয়ার্স অফ এনডেভার’ (১৯৬৯-৭২), ‘ইন্ডিয়া (লন্ডন)’ (১৯৭৫) এবং ‘ইন্ডে (লুসানে)’ (১৯৭৯) নামের সংকলন গ্রন্থগুলোয় তার বহু লেখা ও বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ স্থান পেয়েছে।

বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রিতে সম্মানিত করেছে। ছাত্রজীবনের উজ্জ্বল সফলতার সুবাদে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে বিশেষভাবে সম্মান জানিয়েছে। একইভাবে কর্মজীবনেও তিনি বহু কৃতিত্ব ও সাফল্যের নজির রেখে গেছেন। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘ভারতরত্ন’ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেন ‘মেক্সিকান অ্যাকাডেমি পুরস্কার’ (১৯৭২)। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরাকে দেওয়া হয় এফ এ ওর দ্বিতীয় বার্ষিক পদক। তিন বছর পর ১৯৭৬ সালে লাভ করেন নাগরী প্রচারিণী সভার সাহিত্য বাচস্পতি (হিন্দি) পুরস্কার। ১৯৫৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদার্স অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হন। কূটনীতিতে বিচক্ষণতার জন্য ইতালির আইবেলা ডি এস্ট পুরস্কার ও ইয়েল ইউনিভার্সিটির হোল্যান্ড মেমোরিয়াল প্রাইজ পান। ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ওপিনিয়নের এক জনমত সমীক্ষার নিরিখে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে পরপর দুবার ‘বিশ্বের সেরা মহিলা’ খেতাবে তাকে সম্মানিত করা হয়। একইভাবে ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ পোল সার্ভের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ব্যক্তি হিসেবে তাকে সম্মান জানানো হয়। শুধু মানুষ নয়, প্রাণী ও জীবজন্তুর প্রতি তার বিশেষ যত্নের স্বীকৃতিতে আর্জেন্টাইন সোসাইটি ১৯৭১ সালে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে তাকে।

শুধু ভারতের প্রেক্ষাপটেই নয়, সারা বিশ্বের সামনেই ইন্দিরা একজন বিস্ময়কর নেতা। একজন নারীর প্রতিকৃতির মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের পরতে পরতে ছিল নেতৃত্বের ঈর্ষণীয় গুণাবলি। ছিল সঙ্কট ও সমস্যার পাহাড় ডিঙানোর শক্তি ও সাহস। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার ক্ষমতা আর ইতিহাসে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করার অদম্য প্রতীতি।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর