২৩ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছিল রাতটা। শেষরাতে তখনও জেগেছিলাম। হঠাৎ মোবাইলে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সহকর্মীর মেসেজ। তিনি লিখেছেন—‘ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণের ঘোষণা দিয়েছেন’। তার মেসেজ পড়ে ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই শুরু বিস্ফোরণ। বাড়ির খুব কাছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
কিয়েভ ও আশপাশের বিভিন্ন শহরেও বিস্ফোরণের খবর আসছিল আমাদের (সংবাদকর্মী) হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। সবাই জানাচ্ছিলেন—তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটছে।
কারও বুঝতে বাকি রইলো না—সত্যিই কিয়েভ আক্রমণের মুখে পড়েছে। শুধু ইউক্রেনের পূর্ব দিকের সামনের অঞ্চলে নয়, তিনদিক থেকেই হামলা চালানো হচ্ছিল। রাজধানী কিয়েভের বিভিন্ন জায়গায়ও থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ। ইউক্রেনীয়দের জন্য এটি খুব বড় ধরনের ধাক্কা।
তখন চোখে যেন স্পষ্ট ভাসছিল—ইউক্রেনে আর কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। রুশ সেনাদের আক্রমণে ইউক্রেন এখন মৃত্যুপুরী। তবে সাধারণ মানুষের জন্য আরও বড় আতঙ্কের কারণ ছিল—শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা এবং ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া। কিয়েভের বাসিন্দারা তখন একে-অন্যের থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন।
তবে আতঙ্কের কেন্দ্রে ছিল ডেনিপার নদীর ওপরের সেতুগুলো। সেখানে প্রথমেই বোমা ফেলতে পারে রাশিয়ার সেনারা। এটি করলে শহরের পূর্বের অংশ থেকে পশ্চিমের অংশ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
টানা ৩০ মিনিট ধরে বিস্ফোরণ চলছেই। ঘরের সুরক্ষিত জায়গায় অবস্থান করছিলাম আমরা। কী ভেবে আমার ১০ বছরের ছেলেকে কাপড় পরিয়ে তৈরি করছিলাম। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। নাস্তা হিসেবে আমরা কিছু একটু খেয়ে নিচ্ছিলাম।
জানালা থেকে যতটা সম্ভব দূরে বসেছিলাম। ঘরে কোণে একটি মোমবাতি জ্বলছিল। তবে আমার ছেলে খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। একপর্যায়ে ছেলেটা বমি করতে শুরু করল।
বাড়ির খুব কাছে সুপারমার্কেট। সেখানে হইচই শোনা যাচ্ছিল। উঁকি দিতেই দেখলাম মার্কেটের সামনে বিশাল সারি। এটিএম বুথে ঢুকতে মানুষের হুড়োহুড়ি। বেশিরভাগ পেট্রল স্টেশন খালি হয়ে গেছে।
অনেকে আতঙ্কে আগেই পেট্রল স্টেশন বন্ধ করেছেন। কারণ সেখানে রাশিয়ার সেনাদের বিমান হামলা চালানোর শঙ্কা বেশি। দৃশ্য দেখে স্পষ্ট—গোটা দেশ ভয়াবহ আক্রমণের মুখে।
শহরের সব রাস্তায় যানজট। অভ্যন্তরীণ এবং শহর থেকে বের হওয়ার মূল রাস্তায় রেড সিগন্যাল। গাড়ির দীর্ঘ সারি, চলছে ধীরগতিতে, যা কিয়েভে একেবারে অচেনা। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক। কিন্তু ট্রেনে ওঠা দায়!
মানুষের ভিড়ে সিট তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপায়ও নেই। ওদিকে আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জারি করা সামরিক আইনের কারণে সব বিমান বন্ধ।
রাশিয়ার আক্রমণের আগে বলা হচ্ছিল—ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলো রুশ সেনাদের মূল লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। তবে রুশ সেনারা শুধু সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেনি। ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের অসংখ্য আবাসিক ভবনে হামলা করা হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের অসংখ্য ছবি আসছিল আমাদের কাছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তা ছড়িয়ে পড়েছে।
রাশিয়ান বাহিনীর বোমা হামলায় ইউক্রেনের সব অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত। এমনকি লভিভ শহর, যেটি পোল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা, সেখানেও হামলার আঁচ পড়েছে। সকালে সেখানে সাইরেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং একজন সংবাদকর্মীকে বোমা হামলা থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করতে হয়েছিল বলে খবর পেলাম।
আরেক সহকর্মী রাশিয়ার আক্রমণ থেকে নিজের এবং পরিবারের জীবন বাঁচাতে কিয়েভ থেকে বেরিয়ে গেছেন আগেই। তার ধারণা ছিল—গ্রামাঞ্চল শহরের থেকে নিরাপদ হতে পারে। তবে ঘটেছে উল্টোটা। তাদের ভাগ্যে কি ঘটছে, তা তখনও জানা ছিল না।
কিন্তু উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ থেকে একটি দেশে আক্রমণ করা হলে, সত্যিকার অর্থে আর কোনো নিরাপদ জায়গা থাকে না। ইউক্রেনেও এখন নিরাপদ বলে বিন্দু পরিমাণ জায়গাও নেই। রুশ সেনাদের হামলায় গোটা ইউক্রেনই এখন নরকপুরী।
লেখক: মার্তা শোকালো, বিবিসির ইউক্রেনের সম্পাদক।