কুকুরের মাংস খাওয়া এবং জবাই নিষিদ্ধ করে বিল পাস করেছে দক্ষিণ কোরিয়া সংসদ। এতে ভোক্তাদের কুকুরের মাংস খাওয়ার ঐতিহ্যগত অভ্যাসের অবসান ঘটতে চলেছে দেশটিতে। দেশব্যাপী বিতর্কের পর ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী উভয় দলের সমর্থনে বিলটি পাস হয়।
মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির জাতীয় পরিষদের সংশ্লিষ্ট কমিটি জানিয়েছে, আইনটি কুকুরের উপাদান দিয়ে তৈরি বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বিতরণ ও বিক্রিকে নিষিদ্ধ করছে। তবে যে গ্রাহকরা কুকুরের মাংস বা সম্পর্কিত কোনো পণ্যদ্রব্য খাবে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে না। অর্থাৎ এই আইনটি মূলত কুকুরচাষী বা বিক্রেতাদের লক্ষ্য করে প্রণীত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিলটি দক্ষিণ কোরিয়ার বিভক্ত রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে বিরল দ্বিদলীয় সমর্থন পেয়েছে। শিল্পায়নের সময় থেকে গত কয়েক দশকে কুকুর খাওয়ার প্রতি দেশটির জনগণের মনোভাব দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। ক্ষুধা নিবারণ এবং প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য কুকুর খাওয়ার যে ঐতিহ্য দেশটিতে গড়ে উঠেছিল তা ক্রমশই বিতর্কে পরিণত হয়েছিল।
বিলের বলা হয়, যদি কেউ খাবারের জন্য কুকুর জবাই করে তবে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৩০ মিলিয়ন কোরিয়ান ওয়ান (প্রায় ২৩ হাজার ডলার) পর্যন্ত জরিমানা করা যেতে পারে। আবার কেউ যদি খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুকুরের বংশবৃদ্ধি করে বা জেনেশুনে কুকুর থেকে তৈরি খাবার সংগ্রহ, পরিবহন, সঞ্চয় বা বিক্রি করে তবে তাকেও জরিমানা এবং জেলের মুখোমুখি হতে হবে।
কমিটির মতে, খামার মালিক, কুকুরের মাংসের রেস্তোরাঁ এবং কুকুরের ব্যবসার অন্যান্য কর্মীদের তাদের ব্যবসা বন্ধ বা পরিবর্তন করার জন্য তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ড সময় দেওয়া হবে। এসময় স্থানীয় সরকারকে সেসব ব্যবসায়ী বা মালিকদের অন্যান্য ব্যবসায় স্থানান্তর করতে সহায়তা করতে বলা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
বিলটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওলের কাছে যাচ্ছে। এটি ইউনের শাসক দল এবং প্রধান বিরোধী দল উভয়ের দ্বারাই সংসদে প্রস্তাবিত হয়েছিল। ফার্স্ট লেডি কিম কিওন হির কাছ থেকেও সোচ্চার সমর্থন পেয়েছে এই বিল।
ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ চীনের কিছু অংশের মতো দক্ষিণ কোরিয়ার কুকুরের মাংস খাওয়ার ইতিহাসও পুরোনো। দক্ষিণ কোরিয়ায় কুকুরের মাংসকে গ্রীষ্মকালে তাপ প্রশমনে সহায়ক খাবার হিসেবে ভাবা হতো। যখন দেশটিতে দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি ছিল তখন প্রোটিনের একটি সস্তা এবং সহজলভ্য উৎস ছিল কুকুরের মাংস।
দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষি, খাদ্য ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনুসারে, দেশটিতে প্রায় ১ হাজার ১০০টি কুকুরের খামার রয়েছে এবং এই খামারগুলোতে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন কুকুর লালন-পালন করা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে পশু অধিকার কর্মীরা এ বিষয়ে সোচ্চার হয় এবং সমালোচনামূলক প্রচারণা চালায়। এতে আন্তর্জাতিক অধিকার গোষ্ঠী যেমন হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল (এইচএসআই) এর নজরে আসে বিষয়টি। তখন থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার খামার থেকে কুকুর উদ্ধার এবং তাদের বিদেশে স্থানান্তর করার কাজ করেছে সংস্থাটি।
কুকুরের মাংস খাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ানদের সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গ্যালাপ কোরিয়ার ২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ৬৪ শতাংশ মানুষ কুকুরের মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। ২০১৫ সালের একই ধরনের সমীক্ষায় তার ফলাফল ছিল একেবারেই উল্টো। বিগত বছরগুলোতে কুকুরের মাংস খাওয়া মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সালে দেশটির ২৭ শতাংশ মানুষ কুকুরের মাংস খেত। ২০২২ সালের সমীক্ষায় সে হার মাত্র ৮ শতাংশ।
সরকারি পরিসংখ্যান মতে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে, রাজধানী সিউলে কুকুর পরিবেশনকারী রেস্তোরাঁর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
কোরিয়ায় কুকুরের মাংস নিষিদ্ধের প্রচারাভিযান পরিচালনাকারী ম্যানেজার লি সাং-কিয়ং বলেন, কুকুরের মাংস খাওয়া এবং প্রাণীর জীবন রক্ষা সম্পর্কে গত কয়েক দশক ধরে প্রচারণা চালানোর ফলে মানুষের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে।