থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল হাই একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন থাইল্যান্ডে। এর আগে ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালেও এই দেশে নিযুক্ত ছিলেন কর্মকর্তা হিসেবে।
শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) ব্যাংককের একটি হোটেলে বার্তা'র সঙ্গে থাইল্যান্ড-বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। আলোচনার প্রথম পর্বে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক।
দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই বলেন, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রাজনৈতিক দিক রয়েছে। এর অর্থনৈতিক দিক রয়েছে এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগের একটি দিকও রয়েছে, যা সাংস্কৃতিক পর্যায়ের।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ডই প্রথম রাষ্ট্র যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এই স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্তটি তাদের কেবিনেটে উত্থাপন করে ১৯৭২ সালে আমাদের জানানো হয়। এরপর কূটনৈতিক নোট বিনিময় হয় ১৯৭২ সালের অক্টোবরে। এই নোট বিনিময় হয়, নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত থাই এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মধ্যে। এরপর দীর্ঘ সময় এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় আমরা হয়ত অনেকেই জানি না বা ভুলে যাই, সেটা হচ্ছে থাইল্যান্ডই প্রথম রাষ্ট্র যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, থাইল্যান্ডই প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীকে এই দেশ থেকে ফেরত পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে ওই হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এবং এই অপরাধী ফেরত পাঠানো যে সম্ভব, সেটি থাইল্যান্ড সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। তবে এখন আমরা অনেক দেশেই দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পরেও দণ্ডিত অপরাধীদের ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।
ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে যখন বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর বজলুল হুদাকে ফেরত পাঠানো হয় তখন এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, আকরামুল কাদের। আমি যখন ১৯৯০ সালের দিকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করি স্যারের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল।
বিষয়টা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তখন থাইল্যান্ডের যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন মানবাধিকারকর্মী, ড. সুরিন পেটসোয়ান। পরবর্তীতে তিনি আসিয়ানের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি নিজে যেহেতু মানবাধিকার নিয়ে সচেতন ছিলেন এবং চর্চা করতেন, তাই, তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সবদিক বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত পাঠানো। যদিও থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি ছিল না তারপরও থাই কেবিনেট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। চুক্তি ছাড়াই রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ফেরত পাঠিয়েছিল এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যে, চুক্তি থাকা বা না থাকার চেয়েও রাজনৈতিক সমঝোতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ১৯৭২ সালে থাইল্যান্ড যখন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তখন তার ভিত্তি ছিল এই রাষ্ট্রটি (বাংলাদেশ) এশিয়ার পূর্বাংশে অবস্থিত এবং এদের সঙ্গে থাইদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
এখন থাইল্যান্ড বছরে বাংলাদেশে দেড় বিলিয়ন ডলার রফতানি করে থাকে। আমরা এদিক থেকে একটু পিছিয়ে। আমাদের রফতানি ৬০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
দুই দেশের মধ্যে যেসব পণ্য বিনিময় হয়, সেগুলোর উল্লেখ করেন তিনি। থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য, ফল, বিভিন্ন ধরনের বিয়ের সাজসরঞ্জাম, ফুল রফতানি করা হয়। এছাড়াও কিছু মেশিনারিজ যায় আর বাংলাদেশ থেকে ইদানিং তৈরি পোশাক আসছে। এছাড়াও পাটজাতপণ্য, কিছু মাছ আসে, যেগুলো আমাদের দেশের সামুদ্রিক মাছ কিন্তু আমরা খাই না। সেগুলো কিছু ব্যবসায়ী এদেশে নিয়ে আসেন। এখানে সেগুলো প্রসেস করে আবার বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়।
থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা বৃদ্ধির ক্ষেত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত আব্দুল হাই বলেন, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বৃদ্ধির আরো সুযোগ রয়েছে। এই দেশে আমি ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালেও কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, তৎকালীন সময়ে থাকসিন সিনাওয়াত্রা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তিনি তখন লক্ষ করেন, পুরোনো ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়মিত রফতানি বাজারের বাইরে যেতে চান না। তিনি তরুণ ব্যবসায়ী, যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর, তাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বাজার বিস্তৃত করার অনুরোধ করেন। সেই সময়েই একটি বড় অংশ বাংলাদেশে তাদের ব্যবসাকে প্রসার করেন। একইভাবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদেরও এখন এগিয়ে আসতে হবে। যারা ইউরোপ আমেরিকায় ক্রেতা পেয়েছেন, তারা হয়ত এখনি এখানে আসতে চাইবে না তবে এটাও মানতে হবে, নতুন দেশে ব্যবসা প্রসার করতে কিছুটা সময় লাগবে এবং কাজ করতে হবে অনেক।
বিশ্ববাজারের দুটি চরিত্রের কথা উল্লেখ করেন তিনি। একটি হচ্ছে, মার্কেটে এসে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করা। আরেকটি হচ্ছে, ক্রেতা, মার্কেট খুঁজে আমার দেশে পণ্য কিনতে যাওয়া। আমরা দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ভালো করলেও এখনো ফেরি করে আমাদের পণ্যকে বাইরে নিয়ে যেতে পারিনি উল্লেখযোগ্যভাবে।